“বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ করে সমৃদ্ধ হয়েছে ইউনেস্কোর ইতিহাস”

জর্ডানের রাজকুমারী ও ইউনেস্কোর দূত প্রিন্সেস ডানার অভিমত

জর্ডানের রাজকুমারী ও ইউনেস্কোর শুভেচ্ছা দূত প্রিন্সেস ডানা ফিরাস বলেছেন,”পৃথিবীর পুরো ইতিহাস জুড়েই শক্তিশালী এবং অনুপ্রেরণামূলক কণ্ঠস্বর আন্দোলন এবং সংগ্রামকে বেগবান করেছে এবং পরিবর্তনকে করেছে ত্বরান্বিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি লাইন তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত। প্রতিটি শব্দ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থার সাক্ষ্য বহন করে। তিনি তাঁর জীবনের মধ্য দিয়েই দেখিয়েছিলেন যে তিনি ব্যক্তিগত লাভকে অগ্রাহ্য করে তাঁর দেশ ও দেশের মানুষের জন্য আত্মত্যাগ করতে সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন।”

রোববার ঐতিহাসিক ৭ মার্চ-এর ৫০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে জর্ডানের বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত ওয়েবিনারের প্রধান অতিথির বক্তব্য তিনি এ কথা বলেন।

তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু যখন ঘোষণা করেন “রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দিব”, তাঁর মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় জাতির জন্য তাঁর অপরিমেয় ভালবাসা। বিশ্বের যেকয়টি দেশ যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করেছে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের জাতির পিতা ৭ মার্চ যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা এতটাই প্রেরণাদায়ক ও ঐতিহাসিক যে ইউনেস্কো ২০১৭ সালে তাঁর সেই অবিসংবাদিত ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামান্য দলিল হিসেবে গ্রহন করে।

Travelion – Mobile

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের এক অনন্য সম্পদ উল্লেখ করে ইউনেস্কোর শুভেচ্ছা দূত বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিতে একটি স্বাধীন দেশের ঘোষণা যেমন ছিল সেই সাথে ছিল উপনিবেশিক রাষ্ট্র গুলো যেভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও জাতিগত ভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে তার বিরুদ্ধে একটি সাহসী উচ্চারণ। সম্পদ ও উপযুক্ত সমরাস্ত্র বিহীন একটি ছোট দেশের শুধুমাত্র সহায় সম্বলহীন মানুষের শক্তিকে ভিত্তি করে স্বাধীনতার স্বপ্নকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া ও তাকে বাস্তবায়িত করার ঘটনা বিশ্বে বিরল। যা হয়ত একজন মহান নেতৃত্বের কারনেই সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো তার নিজস্ব ইতিহাসকেই সমৃদ্ধ করল।

আলোচনা সভার শুরুতেই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক, জর্ডানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুধু বাংলাদেশ নয় বরং আজ তা বিশ্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যেরও অংশ। ৭ই মার্চের ভাষণের ঐতিহাসিক স্বীকৃতি শুধুমাত্র তাঁর ভাষণ নয় বরং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও মুক্তি সংগ্রামের মহা নায়কের প্রতিও স্বীকৃতি, যা আজ বিশ্ববাসী অকুণ্ঠচিত্তে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে। সেদিন বঙ্গবন্ধু আপামর জনসাধারনকে যে মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন তারই ঐতিহাসিক ফলাফল স্বাধীনতা, স্বাধীন বাংলাদেশ।

তিনি আরও বলেন, তাঁরই স্বপ্নের আলোকে তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের জন্য কাজ করছেন ক্ষুধা, দারিদ্র ও অভাব হতে মুক্তির জন্য।

অনুষ্ঠানে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে যুক্ত বিশেষ বক্তা জর্ডান ডিপার্টমেন্ট অফ আণ্টিকসের সাবেক পরিচালক, শিক্ষাবিদ ডক্টর মন্থের জামহাওয়ি বলেন, প্রতিটি জাতি তার প্রতিটি ক্রান্তিকালে একজন অনন্য নেতৃত্বকে আশা করে। কিন্তু সব সময় সেটা বাস্তবে ঘটেনা। বাংলাদেশিরা সৌভাগ্যবান যে শেখ মুজিবুর রহমানের মত একজন মহান নেতাকে তারা পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের কারনেই শত প্রতিকুলতা সত্ত্বেও মাত্র নয় মাসের মধ্যে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে।

তিনি বলেন, একাত্তরের ৭ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দিয়েছিলেন নিঃসন্দেহে তা বাঙালি জাতিকে তার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করেছিল। তাঁর ভাষণে যেমন স্বাধীনতার সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা ছিল তেমনি ছিল অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান। আমরা তাঁর ভাষণে পরিশীলিত শব্দের মধ্য দিয়ে দেখতে পাই একটি জাতিকে সংগ্রামের দিকে অনুপ্রাণিত করার এক আকর্ষণীয় অমোঘ আহ্বান। ৭ মার্চের ভাষণ ও এর প্রভাব অতুলনীয়। তাঁর ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও আত্মত্যাগের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখার সংকল্প তা এক কথায় অসাধারন ও অভূতপূর্ব।

ডক্টর মন্থের জামহাওয়ি তাঁর বক্তব্যে শরীফ হোসেন ও পরবর্তীতে কিং আব্দুল্লাহ ও তাঁর সন্তানদের জর্ডানের গোড়াপত্তনে তাঁদের ত্যাগ ও মহিমার কথা ও তুলে ধরেন।

ঢাকা থেকে যুক্ত বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও নাট্যাভিনেতা এম খালেকুজ্জামান ৭১ সালের ৭ মার্চের দিনে রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ব্যক্তিগত উপস্থিত থাকার অনুভুতি ব্যক্ত করে বলেন,বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই মোহ জাগানিয়া রক্তে আগুন ধরানো ভাষণ রেসকোর্স থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত নিমেষেই পৌঁছে গিয়েছিল বাংলার প্রতিটি প্রান্তে, প্রতিটি ঘরে। তাঁর সেই উদ্দাত্ত আহ্বান “যার যা কিছু আছে তা ই নিয়ে ঝাপিয়ে পর অথবা প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল” সেদিন প্রতিটি বাঙালির প্রানের কথা হয়ে ধ্বনিত হয়েছিল বাংলার আকাশে বাতাসে। বঙ্গবন্ধুর বাণী “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” উদ্ভুদ্দ করেছিল বাংলার প্রতিটি মানুষকে। তাঁরই সেই আহবানে সারা দিয়ে মুক্তি সংগ্রামে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল কিষাণ, মজুর, যুবক, বৃদ্ধসহ বাংলার লাখো জনতা। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দীতেও তাই আমরা কান পেতে শুনি বঙ্গবন্ধুর অমর বানী “ আমরা যখন মরতে শিখেছি, কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না”।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাহ আলী ফরহাদ “ওরাটরি ব্রিলিয়েন্স এন্ড স্ট্র্যাটিজিক মাস্টার স্ট্রোক অফ সেভেন্থ মার্চ স্পীচ” শীর্ষক তাঁর উপস্থাপনায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ঐতিহাসিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং আইনগত ভিত্তি চারটি আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে প্রথমত ২৩ বছরের বঞ্চনা, দ্বিতীয়তঃ তৎকালীন রাজনৈতিক অচলাবস্থা, তৃতীয়ত ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা এবং চতুর্থত স্বাধীনতার আশ্বাস ব্যক্ত করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু একদিকে যেমন একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে তাঁর জনগণকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করা এবং আন্তর্জাতিক আইনগত বিষয়টিকে বিবেচনা করে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখেছিলেন।”

শাহ আলী ফরহাদ বলেন, কোন লিখিত বাণী ছাড়াই যে সুচিন্তিত ও গোছানো দৃঢ় বক্তব্য বঙ্গবন্ধু রেখেছিলেন তা বিশ্বে অনন্য। তাঁর প্রতিটি শব্দ চয়ন ও নেতৃত্বসুলভ অভিব্যক্তি তাঁর ভাষণকে করেছে দিপ্ত্যিময়। অগ্নিঝরা ভাষণের প্রতিটি শব্দ শ্রোতার রক্তবিন্দুতে প্রবেশ করেছিল। একজন অসাধারন মহান নেতার মতই তিনি মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিটি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। তাঁর মোহনীয় সেই নির্দেশিকাই অনতিক্রম্য ভবিতব্যের দিকে ধাবিত করেছিল বাংলাদেশকে যার ফলে রচিত হয়েছিল স্বাধীনতার অমর গাথা, রচিত হয়েছিল সবুজ বাংলার মাঝে রক্তে রঞ্জিত লাল-সবুজের পতাকা।

আলোচনা পর্বের শুরুতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ইংরেজি সাবটাইটেলসহ দেখানো হয়। এইদিন সকালে তাবাসে জাতীয় সঙ্গীতের সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিবসটির সুচনা করেন রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান। এসময় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং জর্ডানস্থ বাংলাদেশিরা উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়তে পারেন :
কূটনীতিতে নারীর জ্যোতি
করোনাকালের একজন মানবিক রাষ্ট্রদূতের গল্প
দিবসই প্রমাণ করে নারী এখনো সমতায় পৌঁছেনি
‘আমার কাছে প্রতিদিনই নারী দিবস’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!