‘আমার কাছে প্রতিদিনই নারী দিবস’
সফল কূটনীতিকের ভাবনা
“আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পরিয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীরূপে? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই”, বেগম রোকেয়ার এই অমর বাণী এই শতাব্দীতে এসে অনেকাংশে বাস্তব হয়েছে। মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে সফলতা দেখাচ্ছেন নারীরা। প্রতিটি সেক্টরে বিপুলসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণে সমন্বয়, সহযোগিতায় পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, এমনকি দেশ সঠিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
তেমনি একজন নাহিদা রহমান সুমনা-সফল কূটনীতিক, লাল-সবুজের পতাকার গৌরবোজ্জ্বল প্রতিনিধিত্ব করছেন বিশ্বের বুকে। বর্তমানে ব্রুনাইতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার গুরু দায়িত্ব সামালেন। মুসলিম দেশটিতে তিনিই প্রথম বাংলাদেশের নারী হাইকমিশনার। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই গত বছরের অক্টোবরে হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেন নাহিদা রহমান সুমনা। আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসেই ব্রুনাইয়ের সুলতান হাজ্বি হাসসান আল-বলকিয়াহর কাছে পরিচয়পত্র হস্তান্তর করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন নাহিদা রহমান সুমনা। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্নাতকোত্তর এবং জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পানি আইনে ফেলোশিপ অর্জন করেছেন।
১৭ তম বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের এই কূটনীতিক ১৯৯৯ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে ব্রাজিলে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত, কানাডার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার, কলকাতা ডেপুটি হাইকমিশনে কাউন্সেলর এবং ক্যানবেরার প্রথম সচিব এবং মন্ত্রণালয়ে আঞ্চলিক সংস্থা উইংয়ের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এসময় তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দূতাবাস মোবাইল অ্যাপের ধারণা ও উদ্যোগের শুরু থেকেই বেশ ভূমিকা রেখেছিলেন। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন বিষয়ে যথেষ্ঠ আগ্রহী পেশাদার এ কূটনীতিক সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়েও কাজ করছেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে। দুই ছেলের জননী নাহিদা রহমান সুমনার স্বামী অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব আসলাম ইকবাল। আকাশযাত্রার সঙ্গে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
আকাশযাত্রা : আপনার কাছে নারী দিবস মানে কি?
নাহিদা রহমান সুমনা : আমার কাছে প্রতিদিন নারী দিবস। আমি মনে করি, নারী হোক পুরুষ হোক আমরা এই ধরণীর মানুষ। সুতরাং বিশেষ কোন দিন নই, সোজা কথায় ৩৬৫ দিনই নারী দিবস, প্রতিটি দিন সমান।
আকাশযাত্রা : বর্তমান সময়ে নারীদের অবদানকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
নাহিদা রহমান সুমনা : যুগ থেকে যুগান্তরে নারী পুরুষ সকলে সমান অবদান রেখেই চলেছে, বিশেষ করে সভ্যতার এই বিকাশে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে নারীরা তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখছে, যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছে। এমন কোন পরিসর নেই যে পরিসরে নারীর অবদান নেই, কৃষিতে, পোশাক শিল্পে, চিকিৎসা পেশায়, শিক্ষকতায় প্রতিটি খাতে তাদের অবদান চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেগম রোকেয়ার অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমান নারী সমাজ বেগম রোকেয়ার আন্দোলন সংগ্রামের কারণে বেনিফিট পাচ্ছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীদেরকে নেতৃত্বের সুযোগ দিচ্ছেন। লিডারশিপে নারী থাকায় সমাজে নারীরা এগিয়েছে। বিশ্বের দেশে দেশে নারী নেতৃত্ব, জার্মানিতে ড.অ্যাঞ্জেলা মার্কেল,নিউজিল্যান্ডে জেসিন্ডা আর্ডেন, যুক্ত্ররাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস সবাইতো নারী, মার্চে যিনি চাঁদে যাচ্ছেন তিনিও নারী, রেডিয়া আবিস্কারক একজন নারী, বলা চলে গত দুই বছর ধরে নারীরা এগিয়ে আছে।
আকাশযাত্রা : এই যুগেও নারীরা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে এটিকে কিভাবে দেখেন?
নাহিদা রহমান সুমনা : সভ্যতার ক্রম বিকাশে নারীরা ভূমিকা রাখছে এটি যেমন সত্য। পাশাপাশি শুরু থেকেই নারীদের অবদমনের জন্য সবসময় প্রতিবন্ধকতা ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু আমি বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখি, নারীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা নিরাপত্তা। নারীরা নানা জায়গায় নিরাপদে যেতে পারেন না, নিরাপত্তা স্বল্পতার কারণে। আমি মনে করি, প্রতিটা নারীকে সচেতন হতে হবে, চোখ কান খোলা রাখতে হবে, সর্বোচ্চ শিক্ষিত হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পাশাপাশি নিজেদের মনোবল শক্ত রাখতে হবে।
আকাশযাত্রা : ব্রুনাইয়ে আপনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন, প্রথম নারী রাষ্ট্রদূত হিসেবে আপনার অনুভূতি কি?
নাহিদা রহমান সুমনা : আমি একজন মানুষ। ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি, রাষ্ট্রদূত হিসেবে। সুতরাং আমার পরিচয় আমি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। আমিসহ ব্রুনাইয়ে ৮ টি মিশন প্রধান নারী, ব্রুনাই সরকারের উচ্চপদেও নারীরা অধিষ্ঠিত। আমি যেখানে যাই সেখানে নারী রাষ্ট্রদূত হিসেবে কোন প্রতিবন্ধকতার মধ্য পড়িনি। ব্রুনাইয়ে আমার আগমন পাঁচ মাস, এই পাঁচ মাসে আমার রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমার অনুভূতি সুখকর।
আকাশযাত্রা : বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
নাহিদা রহমান সুমনা : নারীরা তাদের মেধা, শ্রম, সাহসিকতা, শিক্ষা ও নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের দেশ গঠনে কাজ করে যাচ্ছেন এবং একই সঙ্গে ভূমিকা রাখছেন একটি স্বাবলম্বী শিক্ষিত প্রজন্ম গঠনে। নানা অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে যে অভাবনীয় আর্থিক সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও প্রবৃব্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে, তা মূলত নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতির জন্যই। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা একজন নারী, স্পীকার নারী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নারী, সাবেক কৃষিমন্ত্রী নারী, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নারী, প্রতিটি সেক্টরে নারীর পদচারণা। বিশ্বের অনেক উন্নতশীল দেশের চেয়ে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অগ্রগামী।
আকাশযাত্রা : কূটনীতির এই বর্ণিল দুনিয়ায় পথচলার কথা বলছিলেন?দীর্ঘ এই পরিক্রমায় আপনার কূটনীতিক জীবনের স্মরণীয় কিছু পাঠকদের জানাতে চাই?
নাহিদা রহমান সুমনা : আমি মন্ত্রণালয়ের আঞ্চলিক সংস্থা অনুবিভাগের মহাপরিচালক এবং কনস্যুলার ও কল্যাণ অনুবিভাগের প্রধান ছাড়াও দেশের বাইরে বিভিন্ন মিশনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলাম। আমার ২৩ বছরের কূটনীতিক জীবনে উল্লেখ করার মতো কোন স্মৃতিকর কিছু নেই। তবে করোনায় ঘরে বসে কাজ করার অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে বিরাট স্মৃতির। এই করোনাকালে লকডাউনের সময় নানান মিটিং করেছি অনলাইনে, মন্ত্রণালয়ের বৈঠক থেকে শুরু করে বিশ্বের নানান দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা সবই অনলাইনের মাধ্যমে করতে হয়েছে। তা আমার স্মৃতিপটে দারুণ গেঁথেছে। ব্রুনাইয়ে লকডাউন নেই, এখানে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে মিটিং করিদ্বিপাক্ষিক কাজগুলো করছি। কিন্তু বাংলাদেশে লকডাউনের সময়ে অনলাইন মিটিং করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করাকে কূটনীতিক জীবনে স্মৃতির অন্যতম অংশ মনে করি।
আকাশযাত্রা : পরিবার ও কর্মস্থলে পুরুষের কাছে আপনার প্রত্যাশা কি?
নাহিদা রহমান সুমনা : নারী পুরুষ একে অপরের সহযোগী,সহমর্মী। আমার স্বামী ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব। তিনি আমাকে সবসময় উৎসাহিত করেছেন। আমি যেন সিভিল সার্ভিসে আসি। আমার স্বামীর অনুপ্রেরণায় আমি পররাষ্ট্র ক্যাডারে যোগ দিই। আমার দুই ছেলে সন্তানও খুবই সহযোগিতাপূর্ণ। আমি মনে করি, পরিবারের সহযোগিতা পেলে নারীরা আরো এগিয়ে যাবে।
আকাশযাত্রা : কূটনীতিক পেশায় যদি নতুন প্রজন্মের কেউ আসতে চাই, বিশেষ করে মেয়েরা, তাতে আপনার কি পরামর্শ থাকবে?
নাহিদা রহমান সুমনা : একবিংশ শতাব্দীতে নারী শুধু বধূ, মাতা, কন্যা নয়; পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নারীও অংশীদার ব্যাপক। আমি যখন এই পেশায় আছি তখন নারী রাষ্ট্রদূত ছিলেন একজন, এখন আমরা অনেকেই রাষ্ট্রদূত। নতুন প্রজন্মের অনেকেই কূটনীতিক পেশায় এসেছেন। ভবিষতে যারা আসতে চায়, তাদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে, কঠোর পরিশ্রম করার মনমানসিকতা, ডেডিকেটিভ হতে হবে, বৈশ্বিক দুনিয়া সম্পর্কে আপডেট থাকা জরুরী। প্রতিদিন শেখার অভ্যাস গড়তে হবে, মানসিকভাবে এবং শারিরিকভাবে ফিট থাকতে হবে, সবসময় নিজেকে কাজের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে।