‘তারা শুধু শিশুই ছিল’

গাজায় ইসরায়েলের ১১ দিনের হামলায় কমপক্ষে ৬৭ জন ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়েছে। এই সময় ফিলিস্তিনের ছোঁড়া রকেটে ইসরায়েলেরও দুইজন শিশু মারা গেছে। নিউইয়র্ক টাইমস নিহত শিশুদের ছবি দিয়ে ‘তারা শুধুই শিশু ছিল’ শিরোনামে একটি মর্মস্পশী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ইসরায়েলের পত্রিকা হারেটজও গাজায় নিহত ৬৭ জন শিশুর ছবি দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যার শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘এটি হলো যুদ্ধের মূল্য।’

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে গাজায় নিহত শিশুদের পরিবারের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, এই শিশুদের কেউ ডাক্তার কেউ শিল্পী ও কেউ বা দেশ পরিচালনার জন্যে নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিল।

নিহত শিশু হামাদা আল ইমোউর (১৩) বাবা আতিয়া আল ইমোউর বলেন, ‘ঈদের আগের দিন ১২ মে আমার ছেলে চাচাত ভাই আম্মার আল ইমোউরের (১০) সঙ্গে চুল কাটতে যায়। চুল কেটে ফেরার সময় আমার চোখের সামনেই বাড়ির কাছে ইসরায়েলের বোমা হামলায় দুজনে মারা যায়।’ তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারিনি আমি কী দেখছি। এটা খুব ভয়বহ ছিল।’

Travelion – Mobile

নিহত শিশু মাহমুদ তোলবেহর (১২) বাবা হামিদ তোলবেহ বলেন, ‘সে খুবই মেধাবী ছিল। বিজ্ঞান অনেক পছন্দ করত এবং সে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিল। বাড়ির সবকাজে সে সাহায্য করত। আমাদের মেরুদণ্ড ছিল সে।’ ১০ বছরের মেয়েকে হারানো টেক্সিচালক সাদ আসালিয়ি বলেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

রমজান মাসের শেষ রাতে চাচাত ভাইকে সেলুনে নিয়ে যায় মাহমুদ তোলবেহ (১২)। দোকানের দরজায় পা রাখতেই ইসরায়েলের ছোড়া একটি শেল তার মাথায় ও কাঁধে আঘাত হানে। দুদিন পরে তার মৃত্যু হয়। ‘তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল। তাকে কবর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার স্বপ্নগুলোকেও কবর দেওয়া হয়েছে’, তিনি বলেন।

ইয়াহিয়া খলিফা (১৩) বাইক চালাতে পছন্দ করত। কুরআনের কয়েক পারা মুখস্ত ছিল তার এবং সে আল আকসা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে চেয়েছিল বলে জানান তার বাবা মাজেন খলিফা। বলেন, ‘ইয়াহিয়া সবার জন্য লাচ্ছি ও আইসক্রিম আনার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়। কিন্তু, ইসরায়েলের বোমার আঘাতে তার মরদেহ ঘরে ফিরে আসে। সে অনেক মিষ্টি ও নিষ্পাপ ছিল।’

সুহাইব আল-হাদিদি (১২) তার বাবা-মা এবং চার ভাইয়ের সঙ্গে গাজা শহরের জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবিরে বাস করত। সুহাইব মনে করত পৃথিবীতে কেবল পাখিরাই স্বাধীন। তাই সে পাখি খুব পছন্দ করত। তার চাচাত ভাই আবদুল্লাহ আল-হাদিদি জানান, সুহাইবের একটি ককাটিয়াল (পাখির নাম) ছিল এবং এটি তার কাঁধে বসত। ভবিষ্যতে একজন পাখি পালক হওয়া স্বপ্ন ছিল তার। তিনি আরও জানান, তার ভাই ইয়াহিয়া আল-হাদিদী (১০) অনেক লাজুক ছিল এবং বাইক চালানো ও বিড়ালদের সঙ্গে খেলতে পছন্দ করত।

পাঁচ বছর বয়সী ওসামা আল-হাদিদি তার পরিবারের অন্যতম স্টাইলিশ সদস্য হিসেবে পরিচিত ছিল। সে বারবার কাপড় পরিবর্তন করত এবং নিখুঁত চেহারা দেখানোর জন্য খুব যত্ন নিত। প্রতি দু ঘণ্টায় গোসল করত এবং কাপড় বদলাত। আবদুর রহমান আল-হাদিদি (৭) ইংরেজিতে পড়াশোনা করত, তুরস্ক ভ্রমণ করার স্বপ্ন দেখেছিল এবং রিমোট-কন্ট্রোল গাড়ি নিয়ে খেলতে পছন্দ করত বলে তার বাবা মুহাম্মদ আল-হাদিদি জানান।

মুহাম্মদ আল-হাদিদি বলেন, ‘এই চার ভাই তাদের চাচার বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিল। ইসরায়েলের বোমার আঘাতে তারা চার ভাই, তাদের মা, চাচি ও চার চাচাত ভাই নিহত হয়।

আল-কওলাক পরিবার গাজা শহরের আল ওয়াহদা স্ট্রিট সংলগ্ন দুটি অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করত। ১৬ মে রাত ১টার দিকে ইসরায়েলের বোমা হামলায় তাদের পরিবারের আট শিশুসহ ২০ জনের বেশি মারা যায়। নিহত শিশুরা হলো— ইয়ার আল-কওলাক (৯), হালা আল-কওলাক (১২), রুল আল-কওলাক (৫), জায়েদ আল-কওলাক (৮), কুসাই আল-কওলাক (৬ মাস), আদম আল-কওলাক (৩), আহমাদ আল-কওলাক (১৫) ও হানা আল-কওলাক (১৪)। বেঁচে যাওয়া ওয়াসিম আল-কওলাক বলেন, ‘এটি অকল্পনীয়। এটি অত্যাচারেরও অনেক বেশি।’

দিমা আল-ইফরঞ্জি (১৫) পরিবারের বড় সন্তান এবং তার বাবার চোখের মণি ছিল। সে ক্লাসের শীর্ষ ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিল। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় কথা বলত এবং ওষুধ নিয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখত, তার বাবা রামি আল- ইফরঞ্জি জানান। তিনি বলেন, ‘দিমা খুব মেধাবী ছিল। সে বিদেশি ভাষার একজন শিক্ষক ছিল।’

তার ভাই, ইয়াজান আল-ইফরঞ্জিও (১৩) অনেক মিধাবী ছিল। সে ক্লাসে প্রায়শই প্রথমে প্রশ্নের উত্তর দিত, আল- ইফরঞ্জি জানান। তিনি বলেন, ‘ইয়াজান ফুটবল খেলা ও গান শুনতে পছন্দ করত। সে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখত।’

১১ বছর বয়সী মীরা আল-ইফরঞ্জি ডেন্টিস্ট হতে চেয়েছিল এবং আমির আল- ইফরঞ্জি (৯) খুব মেধাবী ছিল এবং তার মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকত। সে ফোনে সকার ও ভিডিও গেম খেলতে পছন্দ করত। ১৬ মে ইসরায়েলের বিমান হামলায় এই চার শিশু ও তাদের মা নিহত হয়।

রমজানের শেষে ঈদ উদযাপনের ভোজ শেষ হওয়া সত্ত্বেও, ডানা ইশকণ্টনা (৯) ও লানা ইশকন্টনা (৫) তাদের নতুন পোশাকে সেজেছিল। তাদের দুই ভাই ইয়াহিয়া ইশকন্টনা (৪) ও জয়ন ইশকন্টনা (২) তা দেখছিল। তাদের চাচা রায়েদ ইশকন্টনা তার ফোনে এই ছবিগুলো ধারণ করেছিল।

রায়েদ ইশকন্টনা জানান, তারপর তিনি পরিবারের জন্য হালকা খাবার, চকলেট ক্যান্ডি বার ও আলুর চিপস আনার জন্য বের হয়েছিলেন। সেই সময় ইসরায়েলের বিমান হামলায় চার শিশু ও তাদের মা নিহত হয়। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করেছিলাম আমি যেন আর না বাঁচি।’

তালা আবু এলউফকে (১৩) তার বাবা ‘গ্যালাক্সি’ বলে ডাকত। কারণ, তিনি ভাবতেন তালার ত্বকের রং গ্যালাক্সি চকলেট বারের মতো। সে তার বাবার সঙ্গে খুব মজা করত এবং তার বাবা ড. আয়মান আবু এলউফ তাকে অনেক আদর করত, তালার চাচাত ভাই আল আবু এলউফ জানায়।

তার ভাই, তৌফিক আবু এলউফ (১৭) খুব পরিশ্রমী ছাত্র ছিল এবং সে তাদের উচ্চ বিদ্যালয়ের শেষ ধাপের পরীক্ষার জন্য গভীরভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিল। আবু এলউফ বলেন, ১৬ মে গাজা শহরের আল ওয়াহদা স্ট্রিটে ইসরায়েলের বিমান হামলায় এই দুই ভাই-বোন ও তাদের বাবা মা মারা যায়।

রাফিফ আবু দায়ের (১০) আঁকতে খুব পছন্দ করত। সে দুদিন আগে ইসরায়েলের বিমান হামলায় গাজা সিটিতে ধ্বংস হওয়া একটি উঁচু ভবনের চিত্র অঙ্কন করেছিল। সেদিন যখন তার মা তাকে দুপুরের খাবারের জন্য ডাকছিল, তখন সে তার ছবিগুলো রং করছিল। তার মা বলেছিল, ‘খাওয়ার পর তুমি আবার অঙ্কন করো।’

রাফিফের এক চাচা জানান, রাফিফ তার অন্য ১৩ জন আত্মীয়ের সঙ্গে একটি ব্যক্তিগত আবাসিক বাগানে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিল। কয়েক মিনিট পর ইসরায়েল পাশের একটি ভবনে হামলা চালায়। শেল ও ভবনের বিভিন্ন অংশ এসে রাফিফের ওপর পড়ে। এতে সে ও তার মামা নিহত হয়।

শিশু মনস্তাত্ত্বিক ওলা আবু হাসাবাল্লা বলেন, ‘যেসব শিশু ধ্বংসস্তূপ থেকে বেঁচে ফিরেছে, যারা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ হারিয়েছে এবং যারা স্কুলে গিয়ে তাদের সহপাঠীদের আর খুঁজে পাবে না, তাদের মানসিক অবস্থা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।’

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ও গাজায় শিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বাধীন সংগঠনগুলো বলছে, হামলার পর থেকে এক ধরনের আতঙ্ক, ভয় আর উদ্বেগের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে শিশুরা। এই অনুভূতিগুলো তাদের মধ্যে দুর্বল স্বপ্ন এবং আত্ম-ধ্বংসাত্মক বা আক্রমণাত্মক আচরণ তৈরি করতে পারে।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ‘গাজায় শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। মিশর ও ইসরায়েলের অবরোধের ফলে তারা নিজ দেশ ও এর বাইরে স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে না। তারা সবসময় যুদ্ধের আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে।’

নিহত শিশুদের দায় এড়াতে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, সাধারণ মানুষ যাতে না মারা যায়, সেজন্য তারা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছিল। তারা মূলত হামাসের বিভিন্ন সুড়ঙ্গ লক্ষ্য করেই বোমা হামলা চালিয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!