অন্ধত্ব আর পোড়া শরীরে দেশে ফিরলেন ওমানপ্রবাসী মহিউদ্দিন

বাংলাদেশ দূতাবাসের মানবিক সহায়তা

অন্ধত্ব আর পোড়া শরীর নিয়ে অবশেষে দেশে ফিরলেন ওমানপ্রবাসী বাংলাদেশি রেমিট্যান্সযোদ্ধা মো. মহিউদ্দিন। বাবা-মা,ভাইবোন, প্রিয়জনদের নয়ন ভরে দেখার শক্তি হারালেও তাদের সানিধ্যে বাকি জীবনটা কাটাতে পারবেন-এর চেয়ে বেশি চাওয়া ছিল না হতভাগ্য এই প্রবাসীর। পুরণ হল সেই আশা, বাংলাদেশ দূতাবাসের মানবিক সহায়তা।

নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরকাকড়া গ্রামের মো. ওজি উল্লার ছেলে মহিউদ্দিন (২৭)সংসারের হাল ধরতে ৩ বছর আগে হয়েছিলেন ওমানপ্রবাসী।

এ বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানী মাস্কাটের বারকা এলাকায় কাজ করতে গিয়ে বড় ড্রিল মেশিনের গ্যাস লাইন বিস্ফোরণ দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। প্রাণে বেঁচে গেলেও তার জ্বলসে যায় পুরো শরীর।

Travelion – Mobile

দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মহিউদ্দীনকে উদ্ধার করে স্থানীয় খৌলা হাসপাতালে ভর্তি করে।

এই হাসপাতালে দীর্ঘ ১১ মাস মাস্কাটের খৌলা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকেন মহিউদ্দিন। শরীরের প্রায় ৭০ ভাগ পুড়ে যাওয়ায় তার মুখমন্ডল বিকৃত আকার ধারণ করে। ওমানী চিকিৎসকদের আপ্রান চেষ্টায় কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠলেও হারিয়ে ফেলেন দু চোখের দৃষ্টি।

মহিউদ্দীন স্পন্সরের (আরবাব) কাজ না করে অন্য জায়গায় কাজ করাতে চিকিৎসা ও দেশে পাঠাতে বিভিন্ন রকম জটিলতা সৃষ্টি হয়। অন্য জায়গায় কাজ করার সময় দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার অজুহাতে দায়িত্ব নিতে আপরাগতা জানান আরবাবা। এ ছাড়া ওমানে অবস্থানরত তার কোন স্বজন সাড়া দেয়নি। শেষ ভরসা ছিল বাংলাদেশ দূতাবাস।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিষয়টি জানানোর পর থেকেই তার পাশে এসে দাঁড়ায় ওমানে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্র্তপক্ষ। দীর্ঘ ৯ সময় চিকিৎসার যাবতীয় খবরা খবরসহ তদারকির পাশাপাশি হাসপাতালের বিল আর ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আইনী প্রকি্রয়া চালিয়ে যায় দূতাবাস।

ওমানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদুত গোলাম সরওয়ারের নির্দেশে এবং কাউন্সেলর (শ্রম) হুমায়ন কবিরের সার্বিক তত্বাবধানে মহিউদ্দিনের সহায়তা কাজে নিয়োজিত হন দূতাবাসের শ্রম শাখার আইন সহকারি ও কল্যাণ ডেস্কের দায়িত্বে থাকা মো.মাসুদ করিম ।

তিনি দূতাবাসের পক্ষে চিকিৎসাসহ যাবতীয় তদারকির পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ আদায়, হাসপাতালের বিল পরিশোধসহ প্রয়োজনীয় সব ধরণের সহায়তায় দ্রুত নিশ্চিত করেন।

২০ হাজার রিয়াল যা বাংলাদেশি প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা হাসপাতালের বিল পরিশোধ করার জন্য আদালত মহিউদ্দিনের পক্ষে রায় দিয়ে আরবাবকে প্রদান নির্দেশ। কিন্তু আর্থিক অস্বচ্ছলতায় আরবাব তা পরিশোধে ব্যর্থ হন।

বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সরাসরি যোগােযােগ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানানো হয় বিল মওকুফের। কর্তৃপক্ষের সাথে কয়েকদফা আলোচনা করেন দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম)। দূতাবাসের অনুরোধে মানবিক দিক বিবেচনা করে খৌলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মহিউদ্দীনের ২ হাজার রিয়ালের চিকিৎসা বিল অবশেষে মওকুফ করে দেয়।

বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষে হাসপাতালে মহিউদ্দিনের চিকিৎসার সার্বক্ষনিক তদারকি করেন  আইন সহকারি মাসুদ করিম
বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষে হাসপাতালে মহিউদ্দিনের চিকিৎসার সার্বক্ষনিক তদারকি করেন আইন সহকারি মাসুদ করিম

এরপর দেশে পাঠানোর উদ্যােগ। এ লক্ষ্যে সব ধরনের আইনী প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে মাসুদ করিম । এরপর নিজস্ব তহবিল থেকে একজন সঙ্গীসহ দুটি বিমান টিকিটের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ দূতাবাস।

মহিউদ্দিনের শরীর আগুনে জ্বলসে গিয়ে বিকৃত হয়ে যাওয়াতে তাকে বহন করতে অপরাহতা জানায় বিমান বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। পরে চিকিৎসকের ছাড়পত্র নিয়ে এবং বিমান ভ্রমণের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী করা হয় মহিউদ্দিনকে। চূড়ান্ত হয় তার দেশে ফেরা।

অবশেষে গত বুধবার (২৫ডিসেম্বর) মধ্যরাতে মাস্কাট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে দেশের পথে রওনা হন মহিউদ্দিন।

বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান আইন সহকারী মাসুদ করিম। এয়ারপোর্টে থেকে নিজ পরিবারের কাছে যাওয়ার জন্য দূতাবাসের পক্ষ থেকে মহিউদ্দিনের হাতে নগদ ১০ হাজার টাকা তুলে দেন তিনি।

বিদায়ের সময় আবেগ আপ্লতু মহিউদ্দিন দূতাবাস ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান এবং দোয়া করেন।

বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পৌঁছেন মহিউদ্দিন। সেখান থেকে এমবুলেন্সে নোয়াখালীতে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে । তাকে কাছে পেয়ে পরিবারের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

পরিবারের সানিধ্যে দৃষ্টিহীন মহিউদ্দিনের বাকি জীবন পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে থাকবেন এমন প্রত্যাশা সবার।

আরও খবর :
পঁচিশ বছর পর দেশে ফেরা হল ওমানপ্রবাসীর

[প্রিয় পাঠক, আকাশযাত্রা প্রবাস বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকসহ কমিউনিটি ও সংগঠনের নানান খবর, ভ্রমণ, আনন্দ-বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। লেখা ছবিসহ মেইল করুন [email protected] এই ঠিকনায়]

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!