পঁচিশ বছর পর দেশে ফেরা হল ওমানপ্রবাসীর
গিয়েছিলেন ৪৩ বছরের যুবা বয়সে, ফিরেছেন ৭০ বছরের বৃদ্ধ হয়ে। মাঝে ২৭ বছর প্রবাসে জীবনযুদ্ধে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিকই একটা বিষয়। কিন্তু ওমানপ্রবাসী নুুরুল হুদার জীবনটা এই স্বাভাবিকতায় পড়ে না। কারণ, টানা ২৫ বছর তিনি দেশে আসতে পারি নি। বঞ্চিত ছিলেন পরিবারের সানিধ্য থেকে। দুর্বিষহ যন্ত্রনায় কাটে এক একটি বছর।
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার সুন্দরপুর গ্রামের সোলতান আহমেদের ছেলে নুরুল হুদা নুরু। ১৯৯২ সালে জীবনের তাগিদে হয়েছিলেন ওমান প্রবাসী। গিয়েছিলেন বৈধ ভিসা নিয়ে। ২৭ বছর ফিরেছেন অবৈধ হয়ে।
জানা যায়, শুরুর দু’বছর বৈধ ভিসা নিয়ে ওমানে কাজ করেন নুরুল হুদা । থাকতেন রাজধানীর মাস্কাটে রুই ওয়েলজা এলাকায়। দুই বছর পর দেশ বেড়াতে যান। পরিবারের সাথে মধুর সময়কাটিয়ে ফিরে আসেন প্রবাসে। সেটাই ছিল তাঁর প্রবাস জীবনের শেষ দেশযাত্রা। আর ফিরতে পারেন নি স্বদেশে। টানা পঁচিশ বছর!
কারণ, ভিসা জটিলতায় অবৈধ। অবৈধ হয়ে নুুরুল হুদা বছর বছর পার করছেন ওমানের প্রবাস জীবন। মাঝে একবার আউটপাশের খবর পেয়েছিলেন। সে সুযোগে দেশে ফিরতে পারতেন। ফিরতে হবে তো আজীবনের জন্য। সংসারের কিভাবে টানবেন। ফিরলেন না ।
দেশে স্ত্রী আর সন্তানসহ সুখের কথা ভেবে অবৈধ হয়ে থেকে গেলেন প্রবাসে। প্রবাসে বৈধ জীবনই যেখানে সংগ্রাম আর কষ্ঠের, সেখানে অবৈধ হয়ে কম বেতনে কাজ করা, আইনের চোখ থেকে বেঁচে থাকা তো চাটিখানি কথা নয়।
দিনরাত ঝুঁকির মধ্যেই কখনো গ্যারেজের শ্রমিক, কখনো নির্মাণ শ্রমিক হয়ে কাজ করেন নুরুল হুদা। খেয়ে না খেয়ে পার করেন এতটা বছর।
এক পর্যায়ে হার মানেন তিনি। শরীর আর কাজ করতে পারছে না। ৭০’র শক্তি দিয়ে কিভাবে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা যায়। এক পর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ দিন অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকেন মাস্কাট আল-ওয়েলজার আবাসিক বিছানায়।
সিদ্ধান্ত নিলেন যেভাবেই হোক দেশে ফিরতে হবে। কিন্তু আউটপাস তো বন্ধ। ফেরা তো সহজ নয়। দমলেন না। চেষ্টা চারিয়ে যান। এক পর্যায়ে শরাণাপন্ন হন মাস্কাটে বাংলাদেশ দূতাবাসে। আশা অসুস্থ কোটার বিশেষ আউটপাস যদি পাওয়া যায়।
কিন্তু আউটপাশ নিতে জরিমানার টাকা কোথায় পাবেন। পেলে বাড়ি ফেরার টিকেট কে দিবেন-এমন সব চিন্তাও নুরুল হুদাকে ভর করে।
সহায়তায় এগিয়ে আসেন ওমানে বাংলাদেশ দূতাবাসের আইন সহকারী মাসুদ করিম। তিনিও চট্টগ্রামের সন্তান। গ্রামে বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলায়। এমন অসহায় প্রবাসীদের পাশে দাঁড়ানো ব্যাপারে তার বেশ সুনাম আছে।
নুরুল হুদার দেশে ফেরার সকল আইনি জটিলতা দ্রুত এবং বিনা খরচে সব সম্পন্ন করেন মাসুদ করিম। এ ক্ষেত্রে বড় সহায়তা ও সুযোগটা দেন ওমানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম সরওয়ারও। তিনি নুরুল হুদার জরিমানা মওকুফের ব্যবস্থা করেন।
এরপর বিমান টিকেট। মাসুদ করিমের অনুরোধে এগিয়ে আসেন ওমানপ্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী আল-ওয়েলজার বাবু। তিনি নিজ খরচে বিমানে টিকেটের ব্যবস্থা করে দেন। চূড়ান্ত হয় নুরুল হুদার দেশে ফেরা।
অবশেষে গত বৃস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) রাতে মাস্কাট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে দেশের পথে রওনা হন নুরুল হুদা। এসময় তিনি দূতাবাস কর্তৃপক্ষসহ সকলের জন্য প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান এবং দোয়া করেন।
নুরুল হুদার বাকি জীবন পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে কাটুক, এমন প্রত্যাশা করেন তাকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে আসা দূতাবাসের আইন সহকারী মাসুদ করিমের।
বিমানবন্দরে নুরুল হুদা ছিলেন আবেগ আপ্লতু। অনেকটা বাকরুদ্ধও। সােনালী সময় হারিয়ে ফেলার দীর্ঘশ্বাসের
সাথে চোখে মুখে পঁচিশ বছর পর স্বজনদের কাছে পাওয়ার ব্যাকলুতা!