করোনার কঠিন পরীক্ষায় ইতালির স্বাস্থ্যসেবা

মঙ্গলবার সবশেষ তথ্য অনুযায়ী ইতালিতে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৪৬৩ জন দাঁড়িয়েছে। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ১৭২ জন এবং সুস্থ হয়ে ওঠেছেন ৭২৪ জন।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি ইতালিতে প্রথম কোভিড ১৯ ভাইরাস আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ে। ষোলো দিন পর করোনায় মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যায় ইতালি হয়ে ওঠে চীনের বাইরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। দেশটির বেশির ভাগ শহরে জনকোলাহল থেমে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তালা ঝুলছে। সুপারশপ, রেস্টুরেন্ট, নাইট ক্লাবগুলোর বেশির ভাগই বন্ধ। সিনেমা হল, যাদুঘরও বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

ইতালি সরকার করোনভাইরাসের প্রাদূর্ভাব রোধে কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ জনগোষ্টিকে লকডাইনের আওতায় আনছে। লমবার্ডিসহ এবং ১৪ টা প্রদেশে অন্তত এক কোটি ৬০ লক্ষ মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই অবস্থা এপ্রিলের প্রথম দিক পর্যন্ত থাকবে।

Travelion – Mobile

ইতালির ২০ অঞ্চলেই করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে জরুরি প্রতিরোধক পদক্ষেপগুলি সারা দেশে প্রসারিত করেছে, যার মধ্যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং জনসমাবেশে নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ব্যায়ামাগার, সুইমিংপুল, যাদুঘর এবং স্কি রিসোর্টগুলো ।

ইতালিতে একজন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) । তবে আক্রান্তের ধরণ গুরুতর না, তিনি সুস্থ আছেন। ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়, করোনা ভাইরাসের কারণে ইতালি প্রবাসী বাংলাদেশীরা শুধু আতঙ্কেই নন তারা চাকরিও হারাচ্ছেন। এই মুহূর্তে ২ লাখ ৬০ হাজারের মতো বাংলাদেশি ইতালিতে রয়েছেন। চীনা মালিকানায় নিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ধ্বস নামায় এর সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশিরা চাকরি হারাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

ইতালিতে করোনায় মৃত্যু বেড়েই চলছ
ইতালিতে করোনায় মৃত্যু বেড়েই চলছ

লমবার্ডিতে বয়োজ্যষ্ঠদের একটি হাসপাতালের পরিচালক লোরেনজো কাসানি শুক্রবার একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমে বলেন, “এমন জরুরি অবস্থার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলাম না আমরা যদিও খুব দ্রুত সাড়া দিয়েছে সবাই। তিনি জানান তাঁর হাসপাতালের বেশিরভাগ রোগী প্রবীণ নাগরিক যাদের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিটা বেশি। ভাইরাস ছড়াতে শুরু করার প্রথম দশদিন তাঁর দম ফেলারও সময় ছিলনা বলে জানান কাসানি।”

তিনি আরো বলেন, “শুরু থেকেই যদি জরুরীভাবে সরকার এটার সংশ্লিষ্ট সকলকে অবগত করত তবে এমন নাজুক পরিস্থিতি হত না। এজন্য তিনি সঠিক পরিকল্পনার অভাবকে দায়ী করেন। প্রাদুর্ভাবটি ইতালিতে ছড়িয়ে পড়ারও প্রায় একমাস আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি টাস্কফোর্স তৈরি করে এবং চীন থেকে সব ফ্লাইট স্থগিত করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু এই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার আগেই ভাইরাসটি ইতালিতে প্রবেশ করেছিল যা থেকে সৃষ্টি হয়েছে দূর্যোগ।

দেশটির সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান মাসিমো গাল্লি স্থানীয় একটি দৈনিকে জানান, যখন ভাইরাসটি দেশে প্রবেশ করে তখন তা সুপ্ত অবস্থায় ছিল। এটি যার ভেতরে ছিল তার ভেতর রোগটির তেমন কোন উপসর্গ দেখা যায়নি। ডিসেম্বরের শেষ দিকে উত্তর ইতালির কডংন হাসপাতালে হঠাৎ অস্বাভাবিক হারে দেখা দেয় নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এই হাসপাতালের পরিচালক স্থানীয় আরেকটি সংবাদপত্রে বলেন, ওই সময় আসা নিউমোনিয়া রোগীদের অনেকেই ভেতরে ভেতরে করোনা আক্রান্ত থাকলেও তাদের স্বাভাবিক শীতকালিন রোগ ভেবেই চিকিৎসা দেন চিকিৎসকেরা।

বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী বোর্ড সদস্য ওয়াল্টার রিকিয়ার্ডি জানান, এই রোগ ইতালিতে ছড়ানোর পেছনে স্বাস্থ্য খাতেরও একটা ভূমিকা আছে। কারণ এই রোগ ভেতরে ভেতরে হাসাপাতালের কর্মকর্তা, চিকিৎসক-কর্মচারীদের মধ্যে ছড়িয়েছে। তিনি বলেন, “হাসপাতালগুলো থেকে আরো দ্বিগুণ মাত্রায় ভাইরাস ছড়িয়েছে। ”

ইতালি থেকে ইউরোপে ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাস
ইতালি থেকে ইউরোপে ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাস

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রথমদিকে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার (এসএসএন) মিশ্র কাঠামোতে কেন্দ্রীয় সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনগুলির মধ্যে সমন্বয় না থাকায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী গুইসেপে কনটের সাথে স্থানীয় গভর্নরদের মধ্যে মতবিরোধ থাকায় পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়েছে। “ এক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরিতে একরৈখিক নীতির খুব দরকার ছিল” মন্তব্য করেন ওয়াল্টার রিকিয়ার্ডি।

ইতালির ডাক্তারদের জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল ফেডারেশন অব দ্যা অর্ডারস অব ডক্টরস এর প্রেসিডেন্ট ফিলিপো আনাল্লি বিশ্ব গণমাধ্যমে জানান, সরকার এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন সুরক্ষামূলক যন্ত্র সরবরাহ করেছে যেমন মাস্ক। তবে এখনও আমরা সংকটের খবর পাচ্ছি নানা জায়গা থেকে।

লমবার্ডির নিবিড়পরিচর্যা কেন্দ্রের ৯৫ শতাংশ শয্যায়পূরণ হয়ে গেছে এবং শয্যা সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে দি অ্যাসোসিয়েশন অব মেডিক্যাল ডিরেক্টরস। সারা দেশে নিবিড় পরিচর্যা বিভাগে বর্তমানে ৬’শ মতো আক্রান্ত রোগী আছে যেখানে জাতীয় সক্ষমতা ৫ হাজার ৩৯৫ শয্যা।

ন্যাশনাল ফেডারেশন অব দ্যা অর্ডারস অব ডক্টরস এর প্রেসিডেন্ট ফিলিপো আনাল্লি বলেন, “যদি লোম্বারডিতে ভাইরাস ঠেকাতে আমাদের সব সক্ষমতা নিয়োজিত থাকে তবে এই ভাইরাস ইতালির দক্ষিণাংশে পৌঁছায় তবে কী হবে ভাবা যায়না। কারণ সেখানে আমরা কর্মী ও সরঞ্জাম দুটোরই অভাব বোধ করি।

করোনার বিস্তার ঠেকাতে উত্তর ইতালির শহরগুলো কার্যত ‘কোয়ারেন্টাইন’ করে রাখা হচ্ছে
করোনার বিস্তার ঠেকাতে উত্তর ইতালির শহরগুলো কার্যত ‘কোয়ারেন্টাইন’ করে রাখা হচ্ছে

বোক্কনি ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্যসেবা খাতের অবজারভেটরির (ওএএসআই) পরিচালক ফ্রান্সেস্কো লোংগো জানান বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে জানান, ওএএসআইয়ের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ইতালিতে পাবলিক হেলথকেয়ারের বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬.৮ শতাংশ যা ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো থেকেও কম। তিনি বলেন, “এই স্বাস্থ্যব্যবস্থা সাধারণ সময়ে ভালভাবেই সেবা দেয় তবে এটি জরুরী অবস্থায় সক্ষমতা ও সরঞ্জামের ঘাটতিতে পড়ে।”

দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, এ ধরনের ঘাটতির মোকাবিলায় দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটগুলোর পরিসর ও সেবা দ্বিগুণ করেছেন। সংক্রামক ব্যাধির ওয়ার্ডগুলিতে শয্যা সংখ্যা দ্বিগুণ করে অবিলম্বে ২০ হাজার নতুন ডাক্তার ও নার্স নিয়োগের ব্যবস্থা নেন। এছাড়াও কম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার চিকিৎসক ও সেনাবাহিনীর চিকিৎসকদের রেড জোনে মোতায়েন করা হচ্ছে ।

লোম্বারডির গভর্নর আত্তিলিয়ো ফনটানা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আহ্বান জানান তাদের এই বছরের স্নাতক শেষ হওয়া নার্সদের সমাবর্তন শিগগিরি শেষ করার। যাতে তারা স্বাস্থ্য খাতের ঘাটতি দূর করতে ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে তিনি বেসরকারী হাসপাতালগুলোকে অনুরোধ করেছেন সেবা প্রার্থীদের জন্য সবসময় সেবার দুয়ার যাতে খোলা রাখা হয়।

সুপিরিয়র হেল্থ ইনস্টিটিউটের (আইএসএস) প্রধান সিলভিও ব্রুসাফিয়ারো বলেন, “আমাদের জাতীয় সেবার জন্য এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। এই দূর্যোগে আমরা অনেক কিছু নতুন কর শিখছি। আমরা নতুন করে অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি যা আগামী দুই মাস পর বলে দিবে আমাদের পদক্ষেপগুলো করোনা ভাইরাস রোধে কতটুকু কার্যকর ছিল।

আগের খবর
ইতালিতে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ কোয়ারেন্টিনে!
করোনায় আক্রান্ত ইতালির সেনাপ্রধান
ইতালির ডেমোক্র্যাটিক পার্টি প্রধান জিঙ্গারেত্তি করোনায় আক্রান্ত
ইতালিতে করোনায় মৃত্যু বেড়েই চলছে, মোট ১৯৭ জন
ইতালিতে করোনায় মৃত্যু ১০৭, এক বাংলাদেশিসহ আক্রান্ত ৩০৮৯ জন

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!