চোরাচালানের দায়ে বরখাস্ত ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রীয় বিমানের সিইও
মাঝে মধ্যে এয়ারলাইন্সের কর্মচারীদের অবৈধ পাচারের অপরাধে বরখাস্ত হওয়া বা গ্রেপ্তার হওয়ার কথা শুনে থাকলে সম্ভবত এই প্রথম বিমানসংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এমনটি হলো। তাও আবার খোদ রাষ্ট্রীয় বিমানসংস্থার প্রধান।
বিনা ঘোষণায় বিলাসবহুল পণ্য আমদানি করে চোরাচালানের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে চাকরি খোয়াচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রীয় বিমানসংস্থা গারুদা ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আই গুস্তি নাগুরাহ আসকারা দানাদিপুত্র।
শুধু তাই নয় এ কাজে তাকে সহায়তার দায়ে শাস্তির খড়গ পড়ছে বিমানসংস্থাটির জড়িত কর্মকর্তাদের উপর। এরই মধ্যেই খবর বেরিয়েছে ৪ পরিচালকে বরখাস্তের।
এরি আসকারা নামে বেশি পরিচিত এই সিইও বিরুদ্ধে নিজের সংস্থার জন্য কেনা নতুন উড়োজাহাজে একটি ক্লাসিক হার্লি-ডেভিডসন মোটরসাইকেল এবং দুটি ব্রম্পটন হাই-এন্ড বাইক চোরাচালানের অভিযোগ উঠেছে।
গত মাসে ফ্রান্স থেকে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় আনা নতুন কেনা এয়ারবাস এ ৩৩০-৯০০ নিও (330-900neo) উড়োজাহাজের মাধ্যমে দেশটিতে আসে বাইকগুলি ।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গারুদা ইন্দোনেশিয়ায় সিইও হিসেবে দায়িত্বে আরি আসকারা। এর আগে তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সমুদ্রবন্দর অপারেটরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন এবং এর আগে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গারুডা ইন্দোনেশিয়ার প্রধান হিসাব কর্মকর্তা (সিএফও) পদে ছিলেন।
সরকারি সংবাদ সংস্থা আনতারার তথ্য অনুযায়ী, বাইকগুলির মূল্য ইন্দোনেশিয়ার বাজারে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৬ লাখ টাকা। বিদেশ থেকে আমদানিতে শুল্ক আসে কোটি টাকার কাছাকাছি। তার মানে সিইও ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন এক কোটি টাকা ।
ইন্দোনেশিয়ার মতো বড় একটি দেশের রাষ্ট্রীয় বিমানসংস্থায় যখন হাজার হাজার কোটি টাকার কারবার। সেখানে সংস্থা প্রধানের এক কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি বোধ করি তেমন বড় বিষয় না হওয়ার কথা, যখন গত এক বছর এই পদে দায়িত্বে পালনে এরি আসকারার বিরুদ্ধে তেমন কোন অভিযোগ নেই ।
কিন্তু বিষযটি যখন আইন লংঘনের পাশাপাশি নৈতিকতা, পদের মর্যাদা আর সংস্থার সুনামের স্বার্থ হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা বড় অপরাধের পর্যায়েই পড়ে। যার শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই মুসলিম প্রধান দেশটিতে।
এটি কেবল একটি দেওয়ানি মামলা নয়, এটি ক্রিমিনাল অফসেন্সও বটে’ এমন মন্তব্য করে, বৃহস্পতিবার (৫ ডিসম্বর) ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থার মন্ত্রী এরিক থোহির ঘোষণা করেন যে, নতুন কেনা উড়োজাহাজে মোটরবাইকে দেশে আনার মাধ্যমে ট্যাক্স এড়ানোর চেষ্টা করার অভিযোগে গারুদা ইন্দোনেশিয়ার সিইওকে বরখাস্ত করা হবে এবং তা নিয়ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হবে।’
থোহির বলেন, ‘এটি এখানেই শেষ হবে না। আরও কর্মচারী জড়িত ছিল কি না তা অনুসন্ধানে তদন্ত অব্যাহত থাকবে।’
‘এই ঘটনাটিটি আমাকে দুঃখ দিয়েছে। আমি যখন দেশের ইমেজ বাড়াতে কাজ করছি তখন [এসওইএস] এর মধ্যে থাকা কিছু লোক প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে না,” যােগ করেন এরিক থোহির ।
প্রশ্নযুক্ত ফ্লাইটটি ছিল ১৬ ই নভেম্বর গারুডা ইন্দোনেশিয়ার বহরে আসা প্রথম এয়ারবাস এ ৩৩০-৯০০ নিও (330-900neo)। একেবারে নতুন বিমানটি পিকে-জিএইচই হিসাবে নিবন্ধিত হয়েছে এবং স্ট্যান্ডার্ড ফেরি ফ্লাইট হিসাবে ফ্রান্সের টুলাউস থেকে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় ননস্টপ উড়েছিল।
গারুডা ইন্দোনেশিয়া তাদের প্রথম ৩৩০-৯০০ নিও ডেলিভারি গ্রহণ করার জন্য দারুণ উচ্ছ্বসিত ছিল, তাই নিয়ম অনুসারে, বিমানসংস্থার সিইওসহ উর্ধবতন কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে উড়োজাহাজটি ডেলিভারি নিতে ফ্রান্সের টলউস এয়ারবাসের ফ্যাটরিতে উড়ে গিয়েছিলেন।
তবে তারা কেবল সাথে নতুন উড়োজাহাজটি নিয়ে আসেন নি; গারুদার ইন্দোনেশিয়ার সিইও আরি আসকারা এই ডেলিভারি ফ্লাইটে একটি হার্লি ডেভিডসন মোটরসাইকেল এবং দুটি ব্রম্পটনফ্লাডিং সাইকেল নিয়ে এসেছিলেন।
ফ্লাইট ম্যানিফেস্টে বলা হয়েছে, ২২ জন যাত্রী ছিলেন এবং কোনও কার্গো ছিল না। তবে শুল্ক ও আবগারি কর্মকর্তাররা সিইও এরি আশকারার হার্লি ডেভিডসনসহ ১৫ টি অনিবন্ধভুক্ত কার্গোরের সন্ধান পেয়েছিলেন নতুন উজােজাহাটিতে ।
শুল্ক কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়,গত বছর ক্লাসিক মোটরসাইকেলের সন্ধানের জন্য বিমান সংস্থা কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন সিইও। ফ্রান্সে এ ধরনের মোটর সাইকেলের খোঁজ পাওয়ার পর চলতি বছেরর এপ্রিলে নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামের গারুদার ইন্দোনেশিয়ার ফিনান্স ম্যানেজারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে মোটরবাইকগুলোর কেনার লেনদেনটি করা হয়।
সমস্যাটা হল, সিইও তার বিলাসবহুল পণ্যগুলি ঘোষণা করেন নি এবং এটি স্পষ্ট মনে হয়েছে এর কোনও তদারকি ছিল না। গারুডা ইন্দোনেশিয়ার এক মুখপাত্র দাবি করেছেন যে পণ্যগুলি ঘোষিত হয়েছিল, তবে সেটি বাস্তবে হয়নি। সম্ভবত পণ্যগুলিতে আমদানি শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা করছিলেন সিইও, যা কয়েক হাজার ডলার হত।
শুল্ক বিভাগ মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় আলাদা আলাদা বাক্সে নিয়ে আসা খোলা বডির হার্লে-ডেভিডসন মোটরবাইক এবং ভাজ করা ব্রম্পটনের বাইকের সন্ধানের কথা। কর্মকর্তারা ১৭ নভেম্বর জার্কাতা বিমানবন্দরে গরুদার রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ থেকে বাইকগুলো বাজেয়াপ্ত করে।
দেশটির অর্থমন্ত্রী মুলানী ইন্দ্রবতী বলেন, অঘোষিত এই বিলাসবহুল পণ্যগুলির জন্য শুল্ক বাবদ অর্ধ বিলিয়ন থেকে ১.৫ বিলিয়ন ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া (বাংলাদেশের মুদ্রায় এক কোটি টাকা) থেকে দেশ বঞ্চিত হয়েছে।
একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে কার্গো তালিকায় মোটরবাইকগুরোকে অন্তর্ভুক্ত না করায় গরুদাকে জরিমানা করা হবে বলে শুক্রবার ঘোষণা দেন ইন্দোনেশিয়ার পরিবহনমন্ত্রী ।
শনিবার গারুদার চিফ কমিশনার সাহালা লুম্বন গাওল একটি টেলিভিশন সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে, এই পরিচালনা পর্ষদের সদস্য যারা “এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন” তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
তিনি বরখাস্ত পরিচালকদের নাম প্রকাশ করতে বা কতজন বরখাস্ত হয়েছেন তা বলতে অস্বীকার করেছেন। তবে এর আগে শনিবার দুপুরে মন্ত্রী এরিক থোহির সাংবাদিকদের বলেছিলেন, গারুদা ইন্দোনেশিয়ার নতুন এয়ারবাসে অবৈধ কার্গো অনুসন্ধানের পরে কমিশনারদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আরও চারজন পরিচালককে বরখাস্ত করা হবে ।
মন্ত্রী বলেন, আজ সকালে গরুদার কমিশনারদের সাথে বৈঠকের পরে নতুন অনুসন্ধান এসেছে যে এটি কেবল একজনের দ্বারা করা হয়নি। এর সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত”।
সিইও আসকারা অভিযোগের বিরুদ্ধে জনসমক্ষে এখনও সাড়া দেননি। সংবাদসংস্থাগুলো মন্তব্যের জন্য তার সাথে যোগাযোগ করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া এ বিষয়ে আনষ্ঠানিকভাবে কোন বিবৃতি দেয় নি গারুদা কর্তৃপক্ষ।
চলে সরে যাওয়া এথন শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বাকি। কারণ এরই মধ্যে নাম ঘোষাণা করা হয়েছে ভারপ্রাপ্ত সিইও নাম।
শুক্রবার এক বিবৃতিতে গারুদা কর্তপক্ষ জানায়, নতুন প্রধানের নাম নির্ধারণের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের সভা অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংস্থার প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ফুয়াদ রিজালকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
চিফ কমিশনার বলেন, গারুদার ব্যবসায়িক কার্যক্রম যাতে কোনও বাধা না পায় সে জন্য অন্তর্বর্তী পরিচালক নিয়োগ করা হবে।