তেলসমৃদ্ধ ওমানের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি তেল উৎপাদন ও বিপনন। বিগত তিন বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের ব্যবসার নিম্নগতি লক্ষ্য করা গেছে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিলাসবহুল পণ্য (যেমন গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক্স আইটেম) বিপনন ব্যবসায়ীরা।
অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সরকারের কৃচ্ছতা সাধন কর্মসূচিতে শ্রমিক নির্ভর কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলশ্রুতিতে বড় বড় কনস্ট্রাকশন কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে এবং অনেক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ে, অনেককে দেশে ফিরে যেতে হয়।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের ৮০% শ্রমিক। বিশেষ করে কৃষি এবং কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন। এরমধ্যে ছোট বড় মাঝারি আকারের ব্যবসায়ী বাকি ২০% (যদিও তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই)।
অনেক ব্যবসায়ী যারা বিগত ২-৩ বছর ধরে লাভের কোন মুখ দেখেছে কিনা সন্দেহ। যারা দু-চারটি পয়সা আয় করেন তাদের সংখ্যা খুবই কম। হাতে গুনার মত। পেশাদারী কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশির সংখ্যা খুবই নগণ্য তার মধ্যে প্রকৌশলী, চিকিৎসক, বিশ্বদ্যালয়ের শিক্ষক ও অন্যান্য উচ্চতর পেশা উল্লেখযোগ্য।
বর্তমানে করোনাভাইরাসে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব পেশার প্রবাসীসহ ওমানের সর্বস্থরের বাংলাদেশি আজ এক প্রকার দিশাহারা।
গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মাঝামাঝিতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ওমান সরকার খুবই সচেতনভাবে এই মহামারী ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়। যার ফলশ্রুতিতে জিসিসসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ওমানের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি অনেক ভাল, আক্রান্ত ও মৃত্যুের হার সবচাইতে কম।
করোনা প্রতিরোধে ঘনবসতিপূর্ণ এবং বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা মাতরাহ (muttrah) ও হামারিয়া (hammriyah)সহ রাজধানী মাস্কাট লকডাউন করে। মেয়াদ বাড়িয়ে তা আগামী ৮ মে পর্যন্ত লকডাউন বলবৎ করা হয়। ফার্মেসি, সুপার মার্কেট, কফি শপ,রেস্টুরেন্ট ছাড়া বাকি সব ধরনের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বন্ধ ঘোষণা করেন এবং এহেন পরিস্থিতিতে মানুষ এক ধরনের গৃহবন্দী জীবন যাপন করছেন বললে অত্যুক্তি হবে না। খাদ্য সংকটে পড়ে অসহায় হয়েছেন অনেক ওমানপ্রবাসী। যদিও মঙ্গলবার থেকে মানি একচেঞ্জসহ আরও কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খেলার অনুমতি দেওয়ায় এবং প্রদেশগুলোর প্রবেশপথে রয়েল ওমান পুলিশের তল্লাশী চৌকি প্রত্যাহার করে নেওয়া পরিস্থিতি কিছু স্বাভাবিক হওয়ার আসা করা যায় ।
ওমানপ্রবাসীদের এই দুর্বিষহ জীবন ও আর্থিক দুর্গতি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হলেও এর সঠিক কোন প্রতিকার আমরা এখনো লক্ষ্য করিনি। মানুষের অর্থের, খাদ্যের, ওষুধের এবং অন্যান্য অভাবগুলো মেটানোর জন্য রাষ্ট্রদূতের ব্যক্তিগত ও সরকারি প্রচেষ্টা, বাংলাদেশে সোশ্যাল ক্লাব ওমান, চট্টগ্রাম সমিতি ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনগুলোর প্রচেষ্টা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য বললেই সই।
বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ৮ লক্ষ বাঙালির ভাগ্যে জুটেছে মাত্র ২০ লাখ টাকা। সরকারের দেয়া তথ্য মোতাবেক থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশে প্রেরিত অর্থের তুলনায় তা অপ্রতুল এবং অবিচারই বলা চলে, যাতে মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও দূরদর্শীতার অভাব সুস্পষ্ট।
প্রবাস কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে প্রবাসী সংগঠনের প্রতিনিধি ও কমিউনিটি সংগঠন বা সামাজিক শক্তিগুলোকে সাথে নিয়ে কাজ করার যে মৌখিকভাবে নির্দেশ দেয়া হলেও কোন কোন দূতাবাস তা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে জানা যায়।
ওমানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম সরওয়ার শুরুতেই ভিডিও বার্তার মাধ্যমে বিত্তবান প্রবাসী ও কমিউনিটির সংগঠনগুলোকে করোনা পরিস্থিতিতে অসহায় বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়ানো আহবান জানান। রাষ্ট্রদূতের আহবান আর নিজেদের মানবিক তাগিদে ওমানে বাংলাদেশি সংগঠন ও বিত্তবানরা আলাদা আলাদাভাবে মানবিক সহায়তা বিতরণ করতে দেখা যায়। এর পাশাপাশি দূতাবাসও সরকার থেকে পাওয়া বাজেটের নিয়ে ত্রাণ মাঠে নামে।
বর্তমান এই পরিস্থিতিতে অসহায় প্রবাসীদের সহায়তায় সবার অবদান নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই, কিন্তু এরপরও এখনও চারিদিকে অসহায় মানুষের হাহাকার শোনা যাচ্ছে। অনেকের ভাগ্যে নানা দিক থেকে একাধিকবার সহায়তা পাওয়ার সৌভাগ্য হলেও অনেকের কপালে কিঞ্চিতও জুটেনি। আর এজন্য সমন্বয়হীনতা দায়ী করছেন অনেকে। দূতাবাস আর প্রবাসী সংগঠনগুলোর মধ্যেকার সমন্বয়ের কথা।
বাংলাদেশ দূতাবাস প্রবাসী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং কমিউনিটি ব্যক্তিত্বদের ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একত্রিত করে ত্রাণ বিতরণের একটি ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিলে আরও বেশি অসহায়কে মানবিক সহায়তা করা যেতে পারে বলে মনে করেছেন অনেকেই। আমাদের অভিমত ওমানে অসহায়প্রবাসীদের খাদ্য সহায়তায় এই মুহুর্তে সবার মধ্যে সমন্বয়টা জরুরী হয়ে পড়েছে।
ওমানের ৮ লাখ জনগণের অনুপাতে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া বাজেট কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তারা কি হিসেবে এই বাজেট বরাদ্ধ করলেন তা বোধগম্য নয়। এর চেয়ে কম সংখ্যাক প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত দেশগুলোতে এর দ্বিগুন ত্রাণ বরাদ্ধ দেওয়া হয়। কাজেই পর্যাপ্ত ত্রাণ তহবিলের ব্যবস্থা এবং দ্রুততার সাথে মাঠ কার্যক্রম পরিচালনা করা অতীব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ত্রাণ তহবিলের বিষয়টি দূতাবাস সরকারের নজরে এনেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি কমিউনিটিকেও যৌথভাবে সরকারের কাছে আবেদন জানানো উচিত বলে আমি মনে করি।
করোনা আতঙ্কের বর্তমান সময়ে কোন প্রবাসীর স্বাভাবিক মৃত্যু হলে মরদেহও দেশে পাঠানোর সুযোগ নেই, অন্য দিকে প্রিয়জনের মৃত্যুতে দেশে যাওয়ারও সুযোগটাও নেই। বর্তমান করোনা সংকট পরিস্থিতিতে অনেক প্রবাসী দেশ ফিরতে উদগ্রীব হয়ে আছেন। অনেকের আবার চিকিৎসাসহ জরুরী প্রয়োজন আছে। কিন্তু বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না।
স্থানীয় পত্রপত্রিকার খবরে দেখা যাচ্ছে ভারত, পাকিস্তান দূতাবাস তাদের এমন প্রয়োজনে পড়া নাগরিকদের দেশে যাওয়ার জন্য বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশিদের এমন ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস উদ্যােগী হবে সে প্রত্যাশা আমাদের।
দুঃসময়ে ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের সব মতাদর্শ ভুলে গিয়ে, মানবতার কল্যাণে সবাই একসাথে কাজ করলে সকল প্রতিকূলতা আমরা অতিক্রম করতে পারব এ বিশ্বাস আমার,আপনার সকলের।
আগের খবর
ওমানে যেসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও কারখানা খোলা যাবে
ওমানে করোনা সংকটে প্রবাসী স্কুলগুলোর ‘ফি’ কমানোর ঘোষণা
ওমানে মানি এক্সচেঞ্জসহ বেশকিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খোলার অনুমতি
ওমানে কমছে করোনার হার, মাস্কাটে একদিনে আক্রান্ত ১৬!