অ্যান্টার্কটিকা : বরফ ছিল না, দাবানলে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল মহারণ্য!

পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতম,শীতলতম এবং শুষ্ক মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা। এই মহাদেশের পরিবেশ এতই দূর্গম যেকোনো মানুষের পক্ষে এই মহাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করা সম্ভব নয়। দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত ১ কোটি ৪০ লাখ বর্গ কিলোমিটার আংতনের বিশ্বের পঞ্চম এই বৃহত্তম মহাদেশের ৯৮ শতাংশ অঞ্চল বরফে ঢাকা আর এই বরফের চাদরের সর্বনিম্ন পুরুত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। পৃথিবীর মোট বরফের ৯০ শতাংশ এবং বিশুদ্ধ পানির ৭০ শতাংশ অ্যান্টার্কটিকাতে জমে আছে।

কিন্তু এক সময় বরফের মহাসাম্রাজ্য ছিল না অ্যান্টার্কটিকা। বরং সেখানে ছিল এতই ঘন মহারণ্য যে, তা দাবানলে দাউদাউ করে জ্বলে, পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল। সেই দাবানলের লেলিহান গ্রাস থেকে বাঁচার জন্য পালাতে চেয়েছিল ভয়ঙ্কর ডাইনোসররাও। পারেনি। অ্যান্টার্কটিকার দাবানল নির্বংশ করেছিল ডাইনোসরদের।

ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে সাড়ে সাত কোটি বছর আগে। পৃথিবীতে তখন চলছে ক্রেটাসিয়াস যুগ। যে যুগ পৃথিবীতে শুরু হয়েছিল আজ থেকে ১০ কোটি বছর আগে। শেষ হয়েছিল আজ থেকে ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে। জন্মের পর থেকে এখনও পর্যন্ত যে উষ্ণতম সময়গুলির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে পৃথিবীকে, ক্রেটাসিয়াস যুগ ছিল তাদের অন্যতম। সেই সময় মাংসাশী ও নিরামিষাশী— দু’ধরনের ডাইনোসরই দাপিয়ে বেড়াত পৃথিবীতে।

Travelion – Mobile

সেই সর্বগ্রাসী দাবানলের পরিণতিতে যে অজস্র চারকোল-এ ভরে গিয়েছিল অ্যান্টার্কটিকা, তারই একটির খোঁজ মিলল অবশেষে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘পোলার রিসার্চ’-এ। গত ২০ অক্টোবর।

গবেষণাপত্রটি জানিয়েছে, সেই উষ্ণতম ক্রেটাসিয়াস যুগেও তখনকার অ্যান্টার্কটিকা ভূখণ্ডের একাংশ ছিল কিছুটা নাতিশীতোষ্ণ। সেই জায়গাটার নাম ‘জেমস রস আইল্যান্ড’। এখন এই ভূখণ্ডটি রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার নীচে। সেই সময় এই দ্বীপটি-সহ গোটা অ্যান্টার্কটিকায় খুব ঘনঘনই হত ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত। বিশাল বিশাল আগ্নেয়গিরি ছিল বলে।

ক্রেটাসিয়াস যুগে কিন্তু সেখানে ছিল মহারণ্য। যা ভরা ছিল খুব উঁচু উঁচু দেবদারু গাছে। সেখানে ছিল প্রচুর ফার্ন গাছ। ছিল অ্যাঞ্জিওস্পার্মের মতো উদ্ভিদ, যাতে নানা রকমের ফুলও ফোটে। গোটা জেমস রস আইল্যান্ডই ছিল ডাইনোসরদের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র। কিন্তু বেশি দিন সেই জেমস রস আইল্যান্ড থাকতে পারেনি ‘স্বর্গরাজ্য’ হয়ে। দাবানলে একেবারে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। সেই মহারণ্য পুরোপুরি জ্বলে-পুড়ে গিয়েই পরিণত হয়েছিল চারকোল-এ। তারই সামান্য কিছু অংশ খুঁজে পান গবেষকরা।

মুদ্রার আকারের সেই জীবাশ্ম, যার মধ্যে মিলেছে চারকোল। ছবি- ‘পোলার রিসার্চ’ জার্নালের সৌজন্যে।
মুদ্রার আকারের সেই জীবাশ্ম, যার মধ্যে মিলেছে চারকোল। ছবি- ‘পোলার রিসার্চ’ জার্নালের সৌজন্যে।

মূল গবেষক ব্রাজিলের ফেডেরাল ইউনিভার্সিটি পারনামবুকো ইন রেসিফ-এর প্যালিয়োবায়োলজিস্ট ফ্ল্যাভিয়ানা জর্জ দ্য লিমা একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘এই আবিষ্কার ক্রেটাসিয়াস যুগে দাবানলের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের এত দিনের ধ্যানধারণাকে সজোরে ধাক্কা দিল। জানা গেল, ঘনঘনই হত সেই ভয়াবহ দাবানল। একটা সময় পর সেই ভয়াবহ দাবানল গোটা জেমস রস আইল্যান্ডের মহারণ্যকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছিল।’’

২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে একটি অভিযানে গিয়ে গবেষকরা জেমস রস আইল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব প্রান্ত থেকে সামান্য কিছু জীবাশ্ম সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরে সেই জীবাশ্মগুলি পরীক্ষা করে তাঁরা কিছু উদ্ভিদের অংশের হদিশ পান। যেগুলি কোটি কোটি বছরের পর চারকোল-এ পরিণত হয়েছে।

যে চারকোলগুলি পেয়েছিলেন গবেষকরা, তাদের আকারও ছিল খুবই ছোট। সবচেয়ে বড় আকারের যে চারকোল খণ্ডটি তাঁরা পেয়েছিলেন, সেটি ছিল কাগজের মতো পাতলা। আড়ে ও বহরে মাত্র ০.৭ ইঞ্চি এবং দেড় ইঞ্চি। তার পর সর্বাধুনিক ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি পদ্ধতিতে তাদের ছবি তুলে গবেষকরা বুঝতে পারেন সেগুলি দাবানলে পুড়ে যাওয়া ‘জিমনোস্পার্ম’ নামে এক ধরনের বিশালাকৃতি উদ্ভিদের জীবাশ্ম। দেবদারু গাছ যে উদ্ভিদ পরিবারের সদস্য, তাদেরই জ্ঞাতি আদতে এই জিমনোস্পার্ম।

পরীক্ষার পর সেই চারকোল। ছবি- ‘পোলার রিসার্চ’ জার্নালের সৌজন্যে।
পরীক্ষার পর সেই চারকোল। ছবি- ‘পোলার রিসার্চ’ জার্নালের সৌজন্যে।

গবেষকরা এই জীবাশ্মগুলি পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, ক্রেটাসিয়াস যুগের শেষের দিকেই অত্যন্ত ভয়াবহ দাবানলের ঘটনা ঘটত জেমস রস আইল্যান্ডে। সেই ভয়াবহ দাবানলের প্রমাণের বেশির ভাগই মিলেছে উত্তর গোলার্ধে। দক্ষিণ গোলার্ধে এখনও পর্যন্ত খুব সামান্যই মিলেছে টাসমানিয়া, নিউ জিল্যান্ড ও আর্জেন্টিনায়। ক্রেটাসিয়াস যুগে এই দেশগুলি ছিল অ্যান্টার্কটিকায় জেমস রস আইল্যান্ডের আশপাশে।

ক্রেটাসিয়াস যুগের শেষের দিকে ‘গন্ডোয়ানাল্যান্ড’ নামে যে মহা-মহাদেশ (‘সুপার কন্টিনেন্ট’)-টি ছিল, তা ভাঙতে শুরু করে নীচে থাকা টেকটনিক প্লেটগুলির মধ্যে তুমুল ধাক্কাধাক্কিতে। তাতেই অ্যান্টার্কটিকা জেমস রস আইল্যান্ড-সহ আধুনিক পৃথিবীর বিশাল একটি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে শুরু করে। সেই সময় বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রাও ছিল এখনকার চেয়ে অনেক বেশি। ঘনঘন আছড়ে পড়ত বিশাল বিশাল উল্কা। ছোটখাটো গ্রহাণুও। সেই সময় ঘনঘন বজ্রবিদ্যুৎ দেখা যেত সেই মুলুকে। আর তা হতও খুব ভয়াবহ ভাবে।

গন্ডোয়ানাল্যান্ডে বড়সড় ভাঙন ধরার ফলে অ্যান্টার্কটিকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার পর থেকেই তা ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে থাকে বরফের মহা-সাম্রাজ্য।
সূত্র : পোলার রিসার্চ’ জার্নাল, আনন্দবাজার পত্রিকা

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!