অবশেষে ফাঁসিতে ঝুলল ভারতের নির্ভয়া-কাণ্ডের ৪ অপরাধী

রেয়ারেস্ট অফ দ্য রেয়ার ক্রাইম। অর্থাত্‍ বিরলতম অপরাধের মধ্যেও বিরল। এমন নৃশংস গণধর্ষণ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল নির্ভয়ার শরীর। দোষী ৬। তার মধ্যে একজন নাবালক হওয়ায় ছাড়া পেয়ে যায় দ্রুত। বাকি পাঁচ জনকে নিয়ে চলতে থাকে টানাপোড়েন। ২০১৩ সালে তিহাড় জেলেই মৃত্যু হয় এক রাম সিং-এর। আত্মহত্যা করে সে। সপ্রিম কোর্ট বাকিদের মৃত্যুদণ্ড দিলেও চলে দীর্ঘ টালবাহানা। কিন্তু হাল ছাড়েননি নির্ভয়ার মা-বাবা। মেয়ের হয়ে লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছিলেন। অতঃপর ২০ মার্চ, ২০২০। ফাঁসির মঞ্চে চার খুনি…

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান। হয়তো শেষপর্যন্ত শান্তি পেল নির্ভয়ার আত্মা, বহুদিনের টালবাহানা, আইনি জটের গেরো পেরিয়ে আজ (শুক্রবার) ভোর সাড়ে ৫টায় ফাঁসি হল ভারতের নির্ভয়া কাণ্ডের ৪ অপরাধীর।

এই প্রথম দিল্লির তিহার জেলে একটি নির্দিষ্ট মামলায় একসঙ্গে ৪ অপরাধীর ফাঁসি হল, ভারতের ইতিহাসেও এই ঘটনা নজিরবিহীন।

Travelion – Mobile

মৃত্যুদণ্ডের সাজা কার্যকর করা হল আসামি অক্ষয় ঠাকুর (৩১), পবন গুপ্তা (২৫), বিনয় শর্মা (২৬) ও মুকেশ সিংয়ের বিরুদ্ধে। স্বস্তি পেল এত বছর ধরে আদালতে চক্কর কাটা নির্ভয়ার পরিবার।

২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে দিল্লির ২৩ বছর বয়সী এক প্যারা মেডিকেল ছাত্রীকে নির্মমভাবে গণধর্ষণ করে রাজপথে ছুঁড়ে ফেলে দেয় মোট ৬ দুষ্কৃতি। বাধা দিতে গিয়ে প্রচণ্ড মারধর খেতে হয় তাঁর পুরুষ সঙ্গীকেও। ঘটনার পৈশাচিকতায় শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ। তরুণীর আসল নাম পরে প্রকাশ্যে এলেও, নির্ভয়া নামেই তিনি পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন তত দিনে। শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি নির্ভয়াকে। নির্মম অত্যাচারের ১৩ দিন পর, ২৯ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।

ওই ঘটনায় (2012 Delhi Rape Case) অভিযুক্ত ৬ জনের মধ্যে একজন নাবালক বলে সংশোধনাগার থেকে ৩ বছর পরে ছাড়া পেয়ে যায় । আরেক অভিযুক্ত রাম সিং জেলের মধ্যেই আত্মহত্যা করে। বাকি ৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে আদালত।

ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই, দিল্লি পুলিশের হাতে একে একে ধরা পড়ে বাস চালক রাম সিংহ, মুকেশ সিংহ (রাম সিংহের ভাই), বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত, অক্ষয় সিংহ এবং এক নাবালক। শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। পুলিশ দাবি করেছিল, হেফাজতে থাকার সময় অপরাধের কথা কবুল করেছিল ৬ জনই।

নির্ভয়ার ধর্ষণ ও খুন দেশকে এতটাই আলোড়িত করেছিল যে, দ্রুত বিচারের জন্য প্রবল চাপ তৈরি হয় সরকারের উপর। ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি দিল্লির সাকেত আদালতে, ধর্ষণ মামলার জন্য দেশের প্রথম ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট চালু হয়। উদ্বোধন করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবির। পরদিনই সেখানে নির্ভয়া মামলার চার্জশিট পেশ করে দিল্লি পুলিশ। নির্ভয়াকে ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, প্রমাণ লোপাট-সহ বিভিন্ন ধারায় এবং নির্ভয়ার বন্ধুকে খুনের চেষ্টার অভিযোগে চার্জ গঠন করে আদালত।

২০১৩ সালেই, ১০ সেপ্টেম্বর ধৃত ছ’জনকে দোষী সাব্যস্ত করেন ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক যোগেশ খন্না। তার আগেই, ১১ মার্চ জেলে আত্মহত্যা করে অন্যতম আসামী রাম সিংহ আর অগস্টে জুভেনাইল কোর্ট তিন বছরের সাজা দেয় নাবালক অপরাধীকে। ১৩ সেপ্টেম্বর বাকি চার সাবালক অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ দেন ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক। আসামী পক্ষের আইনজীবীদের আর্জি খারিজ করে বিচারক খন্না বলেন, এই ঘটনা ‘‘ভারতবাসীর সমবেত বিবেককে ধাক্কা দিয়েছে। তাই আদালত চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারে না।’’

চার প্রাপ্তবয়স্ক ধর্ষক-খুনীই নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে দিল্লি হাইকোর্টে সাজা কমানোর আর্জি জানায়। ২০১৪ সালের ১৩ মার্চ উচ্চ আদালত অপরাধীদের আর্জি খারিজ করে মৄত্যুদণ্ডের আদেশই বহাল রাখে। হাইকোর্ট জানায়, যে ধরনের অপরাধ করেছে দোষীরা, তা ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ শ্রেণিতে পড়ে, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
এর পর, দোষীদের মধ্যে তিন জন— মুকেশ সিংহ, বিনয় শর্মা ও পবন গুপ্ত— ফাঁসির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করার আর্জি জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টেও। কিন্তু ২০১৮ সালের ৯ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ সেই আর্জি খারিজ করে দেয়।

এর পর বিনয় শর্মার হয়ে তাঁর আইনজীবী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আর্জি জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিনয় বলেছিল, তাকে না জানিয়েই এই প্রাণ ভিক্ষার আর্জি জানানো হয়। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সূত্রে জানা যায়, বিনয় তার প্রাণ ভিক্ষার আর্জি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

অন্য দিকে অক্ষয় কুমার সিংহ গত ১০ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টে আলাদা আপিল মামলায় সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করার আর্জি জানায়। ১৮ ডিসেম্বর সে আর্জি খারিজ করে দেয় শীর্ষ আদালত।

এ বছর ৭ জানুয়ারি দিল্লির পাতিয়ালা হাউজ কোর্ট রায় দেয়, ২২ জানুয়ারি সকাল ৭টায় ফাঁসি দেওয়া হবে চার জনকে। এর পর ক্ষমা ভিক্ষা চায় বিনয় এবং মুকেশ। সে আবেদনও খারিজ হয়ে যায়। এর পর ফের রায় সংশোধনের আর্জি জানায় দু’জন। বিনয় দাবি করে, ঘটনার সময় সে নাবালক ছিল। কিন্তু সেই আবেদনও খারিজ হয় শীর্ষ আদালতে। এর পর দিল্লির পাটিয়ালা হাউজ কোর্ট জানিয়ে দেয়, চার জনের ফাঁসি হবে ১ ফেব্রুয়ারি।

কিন্তু ফাঁসি পিছতে এর পরেও আইনি কৌশল থামায়নি অপরাধীরা। শেষ পর্যন্ত ফাঁসির দিন ধার্য হয় ৩ মার্চ। এর মাঝে রায় সংশোধনের আর্জি জানায় পবন। ২ মার্চ তা খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট। ওই দিনই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আর্জি করে পবন। এর জেরে ফের স্থগিত হয়ে যায় ফাঁসি। রাষ্ট্রপতি পবনের প্রাণ ভিক্ষার আর্জি খারিজ করে দেওয়ার পর, চতুর্থ বারের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আদালত। দিল্লির পটিয়ালা কোর্ট জানিয়ে দেয়, ২০ মার্চ ফাঁসি দেওয়া হবে চার জনকে।

এর পরও ফাঁসি রদ বা পিছনোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন অপরাধীদের আইনজীবীরা। সুপ্রিম কোর্টে যেমন নতুন আবেদন করা হয়েছে, তেমনই আবেদন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতেও। কিন্তু এ বার আর কোনও আইনি কৌশলই কাজে লাগেনি…

এবং অবশেষে দীর্ঘ সওয়া সাত বছরের উপর টানাপড়েনের পর, এ দিন ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হল চার জীবিত সাবালক অপরাধীকে।


দেশের মেয়েরা ন্যায়বিচার পেল। নিজের সন্তানের নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর এমনই তৃপ্তির কথা শোনা গেল নির্ভয়ার মা আশা দেবীর মুখে। তিনি বললেন, ‘গত সাত বছর ধরে যাঁরা আমাদের সঙ্গে ছিলেন, গোটা দেশের মানুষ যাঁরা আমাদের সমর্থন করেছেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাব। নতুন ইতিহাস রচনা হল। নির্ভয়া যে ন্যায়বিচার পেল, সে জন্য বিচারব্যবস্থাকে ধন্যবাদ জানাই। আমার আইনজীবীদেরও ধন্যবাদ জানাই।’

আশা দেবী আরও বলেন, অবশেষে তাঁর কন্যা ন্যায়বিচার পাওয়ায় তিনি আজ তৃপ্ত। তাঁর কথায়, ‘এই অপরাধ গোটা দেশের কাছে লজ্জা। আজ দেশ ন্যায়বিচার পেল।’

নির্ভয়া-কাণ্ডের ওই ৪ অপরাধীকে সব আইনি বিকল্পের পথ খুলে দিতে এই পথে হেঁটেছিল দেশের আদালত। শেষ পর্যন্ত আজ অর্থাৎ ২০ মার্চ ফাঁসি দেওয়ার লক্ষ্যে নতুন করে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হয়।

ফাঁসির আগের রাতে নির্ভয়া মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত ওই ৪ আসামি খেতে অস্বীকার চায়নি এবং তারা সারা রাত জেগে ছিল, জানিয়েছেন তিহার জেলের আধিকারিকরা। এই ফাঁঁসি কার্যকরের আগে গোটা তিহার জেলকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়ে ঘিরে রাখা হয়। গোটা জেল চত্বরই ফাঁসির আগের রাতে লকডাউন পরিস্থিতিতে ছিল। তিহার জেল সূত্রে খবর, এশিয়ার বৃহত্তম এই কারাগারের কোনও বন্দিই এদিন চোখের পলকের জন্যেও ঘুমাতে পারেনি।

সবাই যেন প্রহর গুণছিল নির্ভয়া কাণ্ডের আসামিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার জন্যে।

সূত্র :এনডিটিভি ও আনন্দবাজার পত্রিকা

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!