হরমুজ প্রণালী-খাসাব, বাংলাদেশি নিষেধাজ্ঞা!

সম্প্রতি লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের নির্মমতার শিকার হয়েছেন ২৬ বাংলাদেশি। প্রাথমিক খবর ওঠে এসেছে তারা অবৈধপথে ইউরোপ পাড়ি দিতেই দেশ ছেড়েছিল এবং মানবপাচারকারী চক্রের রোষানলের শিকার হয়ে অকালে জীবন দিয়েছেন। এই হতভাগ্যে ভাইদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

খবরে জানাতে পেরেছি, বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে সংযুক্ত আরব আমিরাত এসে সেখান থেকে হরমুজ প্রণালী পাড়ি দিয়ে ইরান, তুরস্ক হয়ে লিবিয়া পৌছেছিল তারা। হুরমুজ প্রণালীর একটি অংশে ওমানের খাসাব আর কর্মসূত্রে এই এলাকার বাসিন্দা আমি। লিবিয়া হতাহত বাংলাদেশিদের হরমুজ প্রণালী পাড়ি দেওয়ার খবর কানে বাজতেই পুরোনো একটি স্মৃতি ভেসে ওঠলো আমার।

বছর দুই আগের কথা। মাস্কাট থেকে ফিরছিলাম কর্মক্ষেত্র খাসাবে। সঙ্গে স্ত্রী-সন্তান। মাস্কাট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন থেকে বলা হলো, আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার কোম্পানি থেকে খাসাব যাওয়ার জন্য (NOC) নো অবজেকশন লেটার দেখাতে পারবেন না, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে খাসাব যাওয়ার বোর্ডিং কার্ড দেওয়া হবে না। এই কানুন-‘অনলি ফর বাংলাদেশি’।

Travelion – Mobile

একে একে ইন্ডিয়া, পাকিস্তানি, নেপালি, শ্রীলংকান, মিশরীয়সহ অন্য দেশের নাগরিকরা কোন লেটার বা নো অবজেকশন ছাড়াই আমাদের দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর মতো হাসি দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। কিছু বাংলাদেশিও পার পেল লেটার দেখিয়ে। আটকা পড়লাম আমরাসহ বেশকিছু বাংলাদেশি। অগত্যা ভিনগ্রহের প্রাণীদের মতো ইমিগ্রেশনের কর্তাদের দিকে শরণার্থীদের মত তাকিয়ে থাকলাম যদি কোন দয়া করে।

ইমিগ্রেশন ডেস্কে আমাদের জটলা দেখে একজন বড় অফিসার এগিয়ে আসলেন। ডেস্কে বসা অফিসারকে জিজ্ঞেস করল ‘লেস মুশকিল (এদের কি সমস্যা)?

উত্তরে ডেস্ক অফিসার বললেন, ‘হাঁদা বাঙালী মাফি রিশালা’ (এরা বাংলাদেশি, এদের কাছে খাসাবে যাওয়ার জন্য চিঠি নেই)

মনে মনে আগে থেকেই আল্লাহকে ডাকছি, এই মুহুর্তে এ ছাড়া আর কোন উপায়ও নাই। বড় অফিসারকে দেখে শরীরের মধ্যে একটি শান্তির হাওয়া বয়ে গেল। মনে হচ্ছিল যেন আল্লাহ তাআলা তার রহমতের দরজা দিয়ে এই ওমানি বড় অফিসার পাঠিয়েছেন এসেছেন, আমাদের উদ্ধার করার জন্য। ওমানিরা হলো আরব জাতিদের মধ্যে সবচাইতে নরম প্রকৃতির মানুষ। সে হিসেবে আশা জাগল খাসাব যাওয়ার বাধা সরবে।

না আমাদের ভুল নিমিষেই ভেঙ্গ গেল। বড় কর্তা রাগ মিশ্রিত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আরবিতে বলল, “হাদা বাঙালি অগেদ মুশকিল, রো বাররা, হাসেল রিসালা সেম সেম আরবাপ )”। বাংলায় তরজমা করলে যা দাঁড়ায় বাঙ্গালীদের অনেক সমস্যা তোমরা বাহিরে চলে যাও এবং তোমাদের স্পন্সর কাছ থেকে চিঠি নিয়ে এসো। বুঝতে পারলাম শপথ নিয়েছে শহীদ হয়ে যাবে কিন্তু বাংলাদেশিদের চিঠি ছাড়া খাসাবে যেতে দিবে না মাস্কাটের ইমিগ্রেসন কর্মকর্তারা।

ওদিকে মাইকে ঘোষণা সুরেলা কন্ঠে আরবি ও ইংরেজিতে ঘোষণা হচ্ছে “Welcome to Muscat international airport, Muscat to Khasab gate is opened, Oman Air at Muscat International Airport will close check-in counters 60 minutes prior to departure।”

ফ্লাইট যে নির্ঘাত মিস হবে ইমিগ্রেসন ডেস্কের কল্যানে বোঝায় যাচ্ছে। টেনশন বাড়ছে। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। এখানকার কানুন নিয়ে তর্ক করার কোন সুযোগ নেই। সেটা আবার হিতে বিপৃরীত হতে পারে।

আমাদের দেশের স্টাইলে শেষ চেষ্টা করতে লাগলাম, যেমন পুলিশে ধরলে নিজের কোনো বন্ধু বা আত্মীয় স্বজন পুলিশের বড় অফিসার থাকলে তাকে ফোন ধরিয়ে দেওয়া। আমি সেই সুত্রেই গেলাম এবং সফল হলাম।

খাসাব মিউনিসিপালিটি একজন পরামর্শক হিসেবে কাজ করার সুবাদে অনেক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে জানাশোনা আছে। কেমনি একজন খাসাব এয়ারপোর্ট ম্যানেজার মোহাম্মদ মহসিনের কাছে ফোন করি। শেষ পর্যন্ত তিনি হলেন আমাদের ‘এনওসি’, এ যাত্রা রক্ষা পেলাম-বাধা পেরিয়ে ফ্লাইটে উঠি।

ফ্লাইটে বসে বার বার একটা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, বিগত ৪ বছরে মাস্কাট টু এবং খাসাব টু মাস্কাট অনেকবার আকাশপথে যাতায়াত করেছি, কোন বার এমন অসুবিধার সম্মুখীন হইনি। কিন্তু এবার কেন বাধা পেলাম। বাংলাদেশিদের ওপর হঠাৎ কেন কানুন কড়া হল।

তবে মাস্কাটেই শেষ নয়, খাসাব এয়ারপোর্টে এসেও বিভিন্ন রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম কোথায় থেকে এসেছে? কোথায় যাব? কি কাজ করি? ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। সন্তোষজনক উতত্তরে ছাড়া পেলাম।

এয়ারপোর্টের ফ্রি পার্কিং জোনে মাস্কাট যাওয়ার সময় রেখে যাওয়া নিজের গাড়ি বের করলাম, রওনা হলাম বাসার দিকে। মাত্র ১০ মিনিটের পথ কিন্তু এরই মাঝে বাধা পড়ল পুলিশের চেকপোস্টে, যা আগে খুব একটা পড়তে হয়নি।

দায়িত্বে থাকা রয়েল ওমান পুলিশের যে অফিসার থামালেন তার নির্দেশ ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাও, গাড়ির মূলকিয়া দেখাও, দেখালাম। এরপর রেসিডেন্ট কার্ড দেখে বাংলাদেশি নিশ্চিত হয়ে বড় অফিসারের কাছে ছুটে গেলেন। বড় কর্তা কার্ডটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পাঁচ মিনিট পরে ফেরত দিয়ে বললেন ‘আপনি যেতে পারেন’।

কি এমন হল খাসাবে বাংলাদেশিদের এমন কড়া নজরদারি। যে শহরকে নিজের মনে করে এতটা বছর কাটিয়ে দিলাম, যে শহর আমাকে চেনে জানে সেই শহরে নিজ কর্মস্থলে, নিজ আবাসস্থলে ফিরতে বাংলাদেশি হিসেবে এত বিড়ম্বনা কেন। এমনটি তো কখনও কল্পনাও করেনি। বাসায় পৌঁছে অনুসন্ধানের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ফোন করলাম। যা শুনলাম তাতে আক্কেল গুড়ুম!

খাসাব শহরটি ওমানের একটি বিচ্ছিন্ন অংশে বিখ্যাত হরমুজ প্রণালীর পাশে অবস্থিত। সড়কপথে এখানে আসতে হলে আপনাকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে হয়ে আসতে হবে। তাছাড়া আপনি সরাসরি আকাশপথে এবং সাগরপথে এখানে আসতে পারেন।

হরমুজ প্রণালী একপাশে হল ওমান খাসাব শহর এবং অন্য পাশে ইরানের বিখ্যাত বন্দর আব্বাস। মাঝখানে অবস্থিত একটি সরু জলপথ। এই প্রণালী পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরবকে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।

জলপথের সবচেয়ে সঙ্কীর্ণ অংশের দৈর্ঘ্য ২১ মাইল ও প্রস্থ ২ মাইল। হরমুজ দিয়েই আন্তর্জাতিক স্তরে তেল রপ্তানি করে সৌদি আরব ও অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী আরব দেশগুলি। বর্তমানে বিশ্বের ৩০ শতাংশ জ্বালানি তেল এই জলপথ দিয়ে রপ্তানি হওয়ার পাশাপাশি একটি সংঘবদ্ধ চক্র আদম পাচারের জন্য ব্যবহার হচ্ছে ।

খাসাবে একজন আইনজীবী জানালেন, খাসাবে বাংলাদেশিদের জীবন জীবিকার জন্য ভিসা হুমকির মুখে। কারণ খাসাব এয়ারপোর্ট দিয়ে আসা ২৫ থেকে ৩০ জনের মতো বাংলাদেশি হরমুজ প্রণালী পার হওয়ার সময় ধরা পড়েছে, যাদের সবাই জেলে বন্দি।

আটক এই লোকগুলি সব আপদ-বিপদ বালা মুসিবত জানার পরেও এসেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জীবনের মহাঝুঁকি ইউরোপ পাড়ি দিতে এসেছিল। তাদের তো যাত্রা ভঙ্গ হল উল্টো আমার যারা শান্তির এই দেশটি বৈধভাবে থেকে রেমিট্যান্স আয়ে পরিশ্রম করে যাচ্ছি তাদেরও নজরদারিতে ফেলে দিলো।

তখন থেকেই নাকি খাসাবে আসা বাংলাদেশিদের ওপর কড়া নজর আনা হয়েছে। ওমানে অন্য জায়গা থেকে বেড়াতে আসা বাংলাদেশিদেরও অনুমতি ছাড়া ঢোকা নিষেধ। শুধু তাই আমাদের মতো যাদের কর্মস্থল এখানে তাদেরও বিশেষ অনুমতি দেখাতে হবে। স্পন্সর, চাকুরিদাতা বা আরবাবের অনুমতি দেওয়া চিঠি থাকলেই খাসাব ঢুকতে দেওয়া হবে। না হলে বিমানবন্দর থেকে পত্রপাঠ বিদায়, যেমনটি হতে গিয়েছিল আমার দশা!

লেখক : ওমানপ্রবাসী বাংলাদেশি প্রকৌশলী, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট প্রফেশনাল

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!