‘যদি রাত পোহালেই শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই’

জাতীয় শোক দিবস

আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির শোকের দিন। জাতির যে শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীনতা এনে দিয়ে বাঙালির মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন, তাঁকেই এই দিনে সপরিবার হত্যা করে জাতিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতিরজনককে সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যার ৪৫ বছর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে রাজধানী ঢাকায় সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। এদিন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালির মহানায়ককে হত্যা করেছিল ক্ষমতালোভী নরপিশাচ কুচক্রী মহল।

বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরঞ্জীব, তার চেতনা অবিনশ্বর। মুজিব আদর্শে শানিত বাংলার আকাশ-বাতাস, জল-সমতল। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের অবিনাশী চেতনা ও আদর্শ চির প্রবহমান থাকবে। জাতির পিতা চেয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে বিশ্বসভায় একটি উন্নয়নশীল, মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। সারা বিশ্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ পালন করছে।

প্রতিবছরের মতো আজও যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যে জাতীয় শোক দিবস ও বঙ্গবন্ধুর ৪৫তম শাহাদাতবার্ষিকী পালনের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। শুক্রবার বিকেল থেকেই রাজধানী ঢাকার অলিগলিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের রেকর্ড করা ভাষণ প্রচার করতে শোনা যাচ্ছে। বাজছে ‘যদি রাত পোহালেই শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই’সহ নানা গান।

Travelion – Mobile

১৯৭৫ সালের কালরাতে বাঙালি জাতির ইতিহাসে কলঙ্ক লেপন করেছিল সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য। তাদের বুলেটে সেদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক ভবনের সিঁড়িতে পড়ে ছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির নিথর দেহ।
সেদিন ঘাতকেরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি। তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।

পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্তবাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন।

ওই সময় দেশের বাইরে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা।

স্বাধীন দেশে কোনো বাঙালি তাঁর নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে না—এমন দৃঢ়বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধুর। সে জন্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবনের পরিবর্তে থাকতেন তাঁর প্রিয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর নিজ বাসভবনে। বাঙালির স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার এ বাড়িটি অসম্ভব প্রিয় ছিল বঙ্গবন্ধুর। এখানে থেকেই বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে সর্বশক্তি নিয়ে ব্রতী ছিলেন। সেদিন ঘাতকদের মেশিনগানের মুখেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকুতোভয়। প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’ কিন্তু ঘাতকের হাত তাতে কাঁপেনি।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশ ছিল তিমিরাচ্ছন্ন। সামরিক স্বৈরশাসন, ক্যু–পাল্টা ক্যু—এভাবে কাটে ১৫ বছর। এ সময় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে হত্যাকারীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়। এমনকি খুনিদের দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। ’৯০–এর গণ–অভ্যুত্থানে গণতন্ত্র ফেরে দেশে। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন। শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার।

নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদকে গত ৬ এপ্রিল ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১১ এপ্রিল রাতে তাঁর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। আরও পাঁচজন আসামি এখনো পলাতক আছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছাত্র অবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন সংগ্রামী নেতা। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফার প্রণেতা ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে এ দেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত করেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলে ষাটের দশক থেকেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়কে পরিণত হন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উত্তাল সমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বজ্রদৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ঘোষণায় উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত জাতি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র পাঠ করে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছিনিয়ে আনে দেশের স্বাধীনতা। জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি এই স্বাধীন বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর গোটা বিশ্বে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। হত্যাকারীদের প্রতি ছড়িয়ে পড়েছিল ঘৃণার বিষবাষ্প। পশ্চিম জার্মানির নেতা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী উইলি ব্রানডিট বলেছিলেন, ‘মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যেকোনও জঘন্য কাজ করতে পারে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!