তরকারি ছাই হলেও নিউজ ছাই করিনি

কথা ছিল না বিদেশে আসার। জীবনটা নিয়তির খতিয়ানে বাঁধা বলেই হয়তোবা প্রবাসে। সংবাদের খোঁজে আজও আমি হেঁটে চলেছি। সেই পথ যেন আর শেষ হয় না। যখন অনার্স প্রথমবর্ষে পড়ি। ওই সময় আমার কয়েকজন বন্ধু লেখালেখি করতো চট্টগামের দৈনিকে। তাদের দেখে আমিও উৎসাহিত হতে থাকি। জাতীয়, স্থানীয় পত্রিকায় টুকটাক লেখালেখি শুরু করে দিলাম। ম্যাগাজিনেও বেশকিছুদিন লিখেছি। ঘটনাক্রমে চলে আসলাম দক্ষিণ কোরিয়ায়। এখানে এসেও থেমে থাকতে পারিনি।

বছর সাতেক আগে জীবিকার তাগিদে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবাসী হওয়া। কোরিয়ান কোম্পানিতে চাকরির পাশাপাশি শখের বসে বেশকিছু পত্রিকা-অনলাইনে প্রবাসকে তুলে ধরার চেষ্টা আমার অবিরত, অবিচল। কতটুকু করতে পারছি না জানি না, তবে বলতে পারি প্রবাস জীবনে পরিবারহীন ‘ছন্নছাড়া’ প্রবাস জীবনে বাধ্যগত রন্ধনশিল্পীর হিসেবে তরকারি ছাই করার অনেক রেকর্ড থাকলেও হলেও নিউজ কখনও ছাই করিনি।

সাংবাদিকতার এই পথে বেশিদূর আর হাঁটা হয়নি। দীর্ঘ পাঁচ বছরের সাংবাদিকতার ইতি টেনে ২০১০ সালে সিউলে জীবন সাজানোর মিছিলে যোগ দিলাম। অন্যদিকে আমার বন্ধুরা লেগেইছিল। তারা এখন নামিদামি সাংবাদিক হয়েছে। আর আমি একজন জীবন সংগ্রামের আন্তর্জাতিক ফেরিওয়ালা হয়ে উঠলাম। এখনও আমার নেশা যায়নি, সুযোগ পেলেই লিখতে বসি। প্রবাসের নানা বিষয়, নানা ঘটনা নিত্যনতুন খবর, মাথায় ঘুরপাক করে।

Travelion – Mobile

বহু রাত কেটেছে ফিচার লিখতে বসে। কমিউনিটি, বিদেশে রাজনৈতিক খবরা-খবর তুলে ধরতে বা দুই দেশের উন্নতির তূলনামুলক বিশ্লেষণ। দূতাবাসের অনুষ্ঠানের খবর বা প্রেস রিলিজ এডিট করতে বা কোনো আন্তর্জাতিক আইকনের কোরিয়া পদার্পণের খবর তড়িৎ জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।’

বছর দুই আগে কোরিয়ার ডিমারকেশনলাইনে মিলিত হন দুই কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুনজে ইন ও কিম জং উন। কী করে এই সংবাদ সুন্দর করে পাঠক উপযোগী করে উপস্থাপন করা যায় সেজন্যই কোম্পানির ডিউটি শেষ করে রাত দশটায় কীবোর্ড ঝড় শুরু, লেখা শেষ করতে করতে রাত চারটা, পত্রিকায় অফিসে পাঠানোর পর মনে মনে বলি কী লাভ?

মনে মনে ভেবে কুল পাই না সকালে আমার চাকরি কে করবে। কে সাহায্য করবে। এসব ভেবে ভেবে ঘুমাতে গেলাম, তিনঘণ্টা ঘুমিয়ে অবশেষে চাকরিতে। অনেক সময় কাউকে নিয়ে ফিচার করার চিন্তা মাথায় বুঁদ হয়ে থাকে, কিন্তু বাসায়তো রান্না নাই, কী করি। নিউজ করব নাকি রান্না। কোম্পানির ডিউটি শেষ করে এসে রান্নার বদলে লেখায় মনোযোগ দিই। লিখতে লিখতে রাতে তিনটা, আর রান্না হলো না। না খেয়ে খালি পেটে ঘুমিয়ে গেলাম, সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার চাকরিতে।

‘কখনো কখনো লেখার নেশায় এত বুঁদ হয়ে যায়, কোথায় আমি তাও জানি না। এখন যেটি লিখছি, পেটে খুব ক্ষুধা কিন্তু মনের ক্ষুধা যে বড় সেটাই লিখছি। অনেক সময় লিখতে বসলে দেশ থেকে আসা আপনজনের ফোন রিসিভ করি না, ব্যাকও করি না, এই যেন অন্য নেশা, অন্যজগত। কয়েকদিন আগে কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। এই সংবাদ কি করে কয়েকটা স্টোরি করে, রিপোর্ট করে পত্রিকায় পাঠাবো সে চিন্তায় ব্যস্ত থাকি কোম্পানির কাজের ভেতর, কী যেন নেশা, নিজেও বুঝি না। না লিখলে ঘুম আসে না।’

এমনও দিন গেছে, লিখতে লিখতে চুলায় রান্না বসানো নিজেই ভুলে গেয়েছি। তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে গিয়ে দেখি, তরকারি পুঁড়ে ছাই। কিন্তু নিউজকে ছাই করিনি। লবণ দিয়ে, মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে রুমে চলে আসলাম। নেশা আর পেশা না মিললেই যা হই। আবার চিন্তা করি এটা যে নেশা। এই পেশায়তো পেট, সংসার কিছুই চলবে না। সারাদিন, সারারাত যেন সংবাদ মাথায় ঘুরে।

সংবাদের খোঁজে প্রতিমুহূর্তেই ঘোরাঘুরি। অনেক কিছুই চোখে পড়ে। নানা বিষয়, কত ইস্যু, যা হয়ত সংবাদ, হয়ত বা সংবাদ নয় কিন্তু অনুসন্ধানী মন, সংবাদ খুঁজে কিছু মন দিয়ে লিখতে চাই৷

দেশ-বিদেশের পাঠকদেরকে শুভাকাঙ্ক্ষীদেরকে প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেছিলেন, ‘যা ভিউস তাই নিউজ।’ আর এই লেখালিখিতে বেড়েছে বন্ধু, বেড়েছে শত্রু। সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সত্যিই প্রবাসে এসে প্রবাস সাংবাদিকতার প্রেমে পড়িলাম। প্রবাস সাংবাদিকতা একধরনের উন্মাদনা, অন্যরকম পাগলামি। তবে এই কথা সত্য, এই পেশার প্রতি দুর্বলতা রয়েছে ছোট বেলা থেকেই। তবে প্রবাসী সাংবাদিকতা যেমন রয়েছে ঝুঁকি, তেমন রয়েছে সম্মান ও রোমাঞ্চ।

অপসাংবাদিকতা বাদ দিলে যেটুকু থাকে তার সবটুকুই আত্মতৃপ্তি। বলাবাহুল্য, Nose for news, এখন প্রবাসে সর্বদা আমি সংবাদের গন্ধ নেয়ার নাক নিয়ে হাঁটি, চলি, ফিরি, ঘুমাতে যাই। সেজন্যই খ্যাতিমানরা বলেছেন ‘সাংবাদিকতা কখনও নীরব হতে পারে না, এটি তার সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ এবং তার সর্বশ্রেষ্ঠ দোষ-হেনরি গ্রুনওয়াল্ড আমেরিকান সাংবাদিক।

‘আমি একজন সাংবাদিক হয়েছি যাতে পৃথিবীর হৃদয়ের সর্বনিকটে পৌঁছাতে পারি’ কথাটি হেনরি লুস, (আমেরিকান সাংবাদিকতার অগ্রদূত)

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!