‘কেউ নেই আমাদের’— চীনে পাকিস্তানি শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ
করোনাভাইরাস আতঙ্ক
করোনাভাইরাস আতঙ্কে চীন থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশের নাগরিকদের দেশে ফিরে আনা হচ্ছে। দেশে ফিরছে, ভারতসহ এশিয়ার বেশিরভাগের দেশে ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে চাকুরিজীবী প্রায় সকল নাগরিক।
যাদের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে এদের মধ্যে বেশিরভাগই করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল উহানের শিক্ষার্থী। উহান শহর লক ডাউন করে দেয়ার পর ফিরে আসার আর কোন সুযোগ না থাকায় নিজ নিজ সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সুবিধায় তাদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়।
উহানই সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাসের প্রকোপ। বিভিন্ন দেশ সেখান থেকে নাগরিকদের ফেরাতে ব্যাপক তৎপর হলেও ব্যতিক্রম কেবলই পাকিস্তান। পাকিস্তান সরকার আগেই চীন থেকে তাদের দেশের নাগরিক না ফেরানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-হু’র সতর্কতার তোয়াক্কা না-করে, বন্ধু দেশের প্রতি ‘সংহতি’ প্রদর্শনে উহানে থাকা পাকিস্তানের নাগরিকদের দেশে না-ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসলামাবাদ।
আর এমনই সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের ও ভারতের ছাত্র-ছাত্রীদের দেশে ফেরা দেখে নিজ দেশের কাছে সাহায্য প্রার্থনায় কাকুতি মিনতি উহান বসবাসরত পাকিস্তানি ছাত্র-ছাত্রীদের। হুবেই প্রদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় আটশ পাকিস্তানি নাগরিক পড়াশোনা করেন।
Pakistani student in Wuhan shows how Indian students are being evacuated by their govt. While Pakistanis are left there to die by the govt of Pakistan: pic.twitter.com/86LthXG593
— Naila Inayat नायला इनायत (@nailainayat) February 1, 2020
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনই এক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে এক পাকিস্তানি ছাত্র দেখাচ্ছেন যে, বাংলাদেশের ও ভারতের ছাত্র-ছাত্রীদের দেশে ফেরাতে উহান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ বাসে করে এয়ারপোর্টের দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পাকিস্তানি পড়ুয়া নিজের দেশের সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বলছেন,
‘বাংলাদেশি পড়ুয়াদেরও কিছুক্ষণের মধ্যেই দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। বাদ রয়ে গেলাম আমরা পাকিস্তানিরাই। আমরা মরে গেলেও আমাদের সরকার আমাদের ফেরাবে না। পাকিস্তানের সরকার আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত! একটু অন্তত শিক্ষা নিন।’
অনলাইন পোর্টাল রিপাবলিকের আরেকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। সেখানে দেখা গেছে নাদিম আব্বাস নামে উহানে আটকে পড়া এক পাকিস্তানি শিক্ষার্থী বলছেন, “দিন দিন এখানকার পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। আমি এরমধ্যে চার পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভাইরাসে আক্রান্তের সংবাদ পেয়েছি। তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে খুব আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন আমাদের পরিবার ও স্বজনেরা। তাই পাকিস্তানি সরকারের কাছে অনুরোধ আমাদের শিগগিরি এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন”।
শনিবার চীনের উহান থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিশেষ উদ্ধারকারি ফ্লাইটে (বিজি ৭০০২) করে ৩১৪ বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বাংলাদেশিদের আকুতিতে দ্রুত সাড়া দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নির্দেশনায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে চীন থেকে বাংলাদেশিরা দেশে ফিরতে সক্ষম হন। অন্যদিকে শনিবার সকালে উহান থেকে প্রথম দফায় ৩২৪ জন ভারতীয়কে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনে এয়ার ইন্ডিয়ার বিশেষ ফ্লাইট। রবিবার দ্বিতীয় দফায় নিয়ে আসা হয় আরও ৩২৩ জন ভারতীয় নাগরিককে। দ্বিতীয় ফ্লাইটে মালদ্বীপের ৭ জন নাগরিককেও উদ্ধার করে নিয়ে আসে ভারত সরকার। যার কারণেভারতের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে মালদ্বীপ সরকার।
পাকিস্তানি শিক্ষার্থীদের এমন দশা নিয়ে কথা হয় উহান ফেরত বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির সাথে। উহানের সেন্ট্রাল চায়না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আশকোনা হাজী ক্যাম্পে পর্যবেক্ষণে থাকা বাংলাদেশি ফাহিম আবদুল্লাহ বলেন, “আমরা যেদিন দেশে ফিরছিলাম সেদিন কয়েকজন পাকিস্তানি বন্ধু আমাদের ডর্মের দরজায় বিদায় দিতে আসে। আমাদের দেশে ফেরা নিয়ে তারা শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছিলেন- ইউ গাইজ আর লাকি। এসময় তাদের অনেকেই আমাদের ফিরে যাওয়া দেখে খুশি হলেও নিজেদের না ফিরতে পারা নিয়ে আফসোসের সুরে কথা বলছিলেন।”
উহান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী জানান, উহানে বন্দি হয়ে পড়ার অসহায়ত্বের কথা তুলে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি শিক্ষার্থী নিজেদের সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে দেখেছি। এই ভিডিওতে আমি দেখেছি পাকিস্তান সরকারের প্রতি তাদের শিক্ষার্থীদের আকুতি। ভিডিওতে তারা বলছে, “উহান শহরকে পুরোপুরি লক ডাউন করে দেয়া হয়েছে। বন্দি অবস্থায় আমরা দিনাতিপাত করছি। আমাদের যদি মুসলমান বা অন্তত মানুষ মনে করে থাকেন তবে আমাদের জন্য কিছু একটা করুন”।
এদিকে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে গত চার দিন ধরে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় চীনা জিনজিয়াংয় প্রদেশের একটি বিমানবন্দরে আটকে থাকা প্রায় দেড়শ পাকিস্তানি নাগরিকের একটি দল ইসলামাবাদে সরকারকে তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এসব নাগরিকদের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার এবং বাকীরা ব্যবসায়ী।
তারা চিন জিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী ইরাকির বিমানবন্দরে বেশ কয়েকদিন ধরে আটকা পড়েছিল । তারা বিমানবন্দর ছেড়ে যেতে পারে নি কারণ তাদের অনেকেইর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে গেছে বা প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষিতে চীন থেকে পাকিস্তান বিমান চলাচল স্থগিত হওয়ায়।
বিপদের দিনে চীনের পাশ থেকে সরে যেতে চায় না পাকিস্তান। বেইজিংয়ের দুর্দিনে পাশে রয়েছে ইসলামাবাদ। উহান প্রদেশে আটকে থাকা পাকিস্তানি নাগরিকদের দেশে ফেরানোর কোনো ব্যবস্থা করছে না পাকিস্তান প্রশাসন। বরং ‘সহমর্মিতা’ জানাতে পাকিস্তানি নাগরিকদের চীনে রাখারই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের।
ডন নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিশেষ সহযোগী জাফর মির্জা জানান, এখন আমাদের বন্ধু চীনের পাশে দাঁড়ানোর সময়। চীন থেকে কোনো নাগরিককে সরানো হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মেনে চীন যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমরাও সেই সিদ্ধান্তে সহমত পোষণ করছি। চীনের এই দুর্দিনে আমরা পাশে আছি।
তিনি আরো বলেন,’উহান প্রদেশে মহামারী রুখতে যথেষ্ট তৎপরতা নিয়েছে চীন সরকার। চীনের প্রতি আমাদের আস্থা আছে।’