লিবিয়া হত্যাকাণ্ডে আহত ৯ জনকে ফিরিয়ে এনেছে সিআইডি

লিবিয়ায় দালালের খপ্পরে পড়া এবং বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে আহত ৯ জন প্রবাসী বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখা ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। লিবিয়ার মিজদা শহরে গত ২৯ মে মানবপাচারকারীদের হাতে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ২৬ বাংলাদেশি। আহত হন দেশে ফেরা এই ৯ জনসহ মোট আরও ১২ জন।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে ৫ টায় বোরাক এয়ারের বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফিরে আসে এই ৯ জন লিবিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহযোগিতায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ৯ জনকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরিয়ে এনেছে। এরা হলেন- ফিরোজ বেপারি, জানু মিয়া, ওমর শেখ, সজল মিয়া, তরিকুল ইসলাম, বকুল হোসেন, মো. আলী, সোহাগ আহমেদ ও সাইদুল ইসলাম।

রোববার সিআইডি লিবিয়াফেরত ব্যক্তিদের এক সংবাদ সম্মেলনে হাজির করে। এরপর তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় আদালতে। সেখানে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তাঁরা।

Travelion – Mobile

সংবাদ সম্মেলনে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের জানু মিয়া বলেন, লিবিয়ায় যেতে তিনি স্থানীয় দুই দালাল সোহাগ ও শ্যামলকে ধরেছিলেন। তাঁদের অফিস আছে মতিঝিলে। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর জানু সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যান। বাসে করে কলকাতা নিউমার্কেটের কাছের একটি হোটেলে ওঠেন। সেখান থেকে পরদিন প্লেনে মুম্বাই চলে যান। ওখানকার বাঙালি দালাল তাঁকে দুবাই পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সেখানেও বাঙালি দালালদের পান। ওই দালালেরা শারজায় কয়েক দিন থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন জানু মিয়ার। সেখান থেকে মিসর পৌঁছে আরও অন্তত ১০০ মানুষকে পেয়ে যান জানু। এরপর তাঁরা পৌঁছান লিবিয়ার বেনগাজিতে। বেনগাজির একটি কারখানায় যোগ দেওয়ার পর জানু মিয়া বুঝতে পারেন তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছে দালাল চক্র। মাসে ৪০ হাজার টাকা বেতন পাবেন—এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তিনি ১৭–১৮ হাজার টাকার বেশি পাননি।

লিবিয়ায় গিয়ে মো. বকুল হোসেন (বাঁয়ে) হারিয়েছেন হাতের দুটি আঙুল। অন্যদিকে জানু মিয়ার পেটের একপাশে হয়েছে গুলির ক্ষত।
লিবিয়ায় গিয়ে মো. বকুল হোসেন (বাঁয়ে) হারিয়েছেন হাতের দুটি আঙুল। অন্যদিকে জানু মিয়ার পেটের একপাশে হয়েছে গুলির ক্ষত।

ওই সময় বেনগাজিতে বসবাসরত দালাল কিশোরগঞ্জের ভৈরবের তানজুল জানু মিয়াকে বলেন, ত্রিপলিতে গেলে অনেক টাকা বেতনে চাকরি পাওয়া যাবে। জানু মিয়া ভয় পাচ্ছিলেন প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরের শহরে যেতে। তানজুল বলেন, ৬০ হাজার টাকা দিলে তিনি সব দায়িত্ব নেবেন। জানু মিয়ার বড় ভাই মুন্না নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে তানজুলের বড় ভাইকে ওই টাকা পরিশোধ করেন। বেনগাজি থেকে ৩০ জন বাংলাদেশি ৩টি গাড়িতে করে রওনা দেন। গাড়ির তিন চালক ছিলেন লিবীয়। ত্রিপলি পৌঁছানোর আগে তাঁদের ওপর হামলা চালায় অপহরণকারীরা। একজন গাড়ির সিটের নিচে লুকিয়েছিলেন। ওই ব্যক্তি বাদে ২৯ জনকে একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন দিন পর তাঁদের সবাইকে আরেক দলের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাঁরা মিজদাহতে পৌঁছান ২০ মে। অপহরণকারীরা ক্যাম্পে ঢুকেই লাশ দেখতে পান। তাঁরা জানান, প্রত্যেকে ১২ হাজার ডলার দিলে ছাড়া পাবেন। নইলে তাঁদেরও মরতে হবে। প্রতিদিনই দু–তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হতো। বাংলাদেশি ছাড়াও ওখানে নাইজেরিয়া, ঘানা ও সুদানের নারীসহ শতাধিক মানুষ আটক ছিলেন।

জানু মিয়া জানান, একদিন বেদম মারপিটের মুখে নাইজেরিয়ার নাগরিকেরা পাল্টা হামলা করে একজন অপহরণকারীকে হত্যা করেন। এরপরই সবার ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়, ককটেল ছোড়া হয়। গুরুতর আহত ১২ জন বাংলাদেশিকে অপহরণকারীরা দূরের একটা মরুভূমিতে ফেলে চলে আসে। দুই–আড়াই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা এক সুদানি নাগরিকের আশ্রয় পান। তিনিই সেনাসদস্যদের হাতে তুলে দেন বাংলাদেশিদের। ত্রিপোলির একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও, কেউ দেখাশোনা করছিল না বাংলাদেশিদের। পরে সে দেশের বাংলাদেশি দূতাবাসের হস্তক্ষেপে চিকিৎসা হয় তাঁদের।

এ ঘটনায় দেশে ২৬ মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সিআইডি বাদী হয়ে রাজধানীর পল্টন ও বনানী থানায় তিনটি মামলা করে। এর বাইরের র্যাবের ও বিভিন্ন থানায় করা আরও ১৩ মামলা নিজ উদ্যোগে গ্রহণ করে সিআইডি। সিআইডির তদন্তাধীন ১৫টি মামলায় এখন পর্যন্ত ৪৪ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। লিবিয়ায় থাকা দালাল ও মূল আসামিদের গ্রেফতারের জন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছেে।

এ ঘটনার পর সিআইডি আহত বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই ব্যবস্থা করেন। মামলার তদন্তের স্বার্থে আহতদের মধ্যে বাকি তিনজন বাপ্পী দত্ত, সম্রাট খালাসী ও সাজিদ লিবিয়ায় রাখা হয়েছে সিআইডি কর্মকর্তা জানিয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!