বৈরুত বিস্ফোরণ : ১২ বছর ছেলেকে দেখেনি মেহেদীর বাবা

লেবাননপ্রবাসী বাংলাদেশি রেমিট্যান্সযোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেহেদী। বা তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে মেহেদী সবার বড় ছিলেন। তাঁর পরই ছিলেন বোন জিয়াসমিন আক্তার (২২)। আর বাকি দুই ভাইয়ের বয়স ১৩ ও ৫ বছর। বা তাজুল ইসলামও ছিলেন প্রবাসী, থাকতেন বাহরাইনে।

মেহেদীর বয়স যখন ১২ বছর, তখন তাঁর বাবা তাজুল ইসলাম বাহরাইনে যান। ছয় বছর পর একেবারে দেশে চলে আসেন তাজুল ইসলাম। কিন্তু এর আগে মেহেদী লেবাননে পাড়ি জমান। ছেলের সঙ্গে ১২ বছর ধরে তার বাবা তাজুলের দেখা নেই। কে জানত, ১২ বছর আগের সেই সাক্ষাৎ ছিল বাবা-ছেলের শেষ সাক্ষাৎ। বৈরুত বিস্ফোরণের শিকার হয়ে মেহেদী অকালে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সুযোগ থাকলো না বাবা-ছেলের দেখার।

মঙ্গলবার লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বন্দর এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি রয়েছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেহেদী তাঁদের একজন। সদর উপজেলার মাছিহাতা ইউনিয়নের ভাদেশ্বরা গ্রামে রাস্তার পাশেই মেহেদীর বাড়ি।

Travelion – Mobile

আগের খবর – বৈরুত বিস্ফোরণ : বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২১ সেনা আহত, যুদ্ধ জাহাজের ক্ষতি

মেহেদি হাসান বৈরুতের আশরাফিয়া এলাকার একটি আট তলা ভবনের নিচ তলায় থাকতেন৷ কাজ করতে সেখানকারই একটি স্পেনিস সুপার শপে৷ তার সঙ্গে থাকতেন আরেক বাংলাদেশি সুজন হোসেন৷ তিনিও ওই এলাকার একটি জুস কারখানার শোরুমে কাজ করেন৷ সুজন জানান, তাদের বাসা থেকে বিস্ফোরণের স্থল বৈরুত পোর্ট তিন কিলোমিটার দূরে৷ ‘‘আমি বাসা থেকে বের হয়ে আমার কর্মস্থলে যাচ্ছিলাম৷ আমার রুমমেট তখন কর্মস্থলে ছিলো৷ আমি হেঁটেই যাচ্ছিলাম৷ সন্ধ্যা ছয়টার একটু বেশি হবে৷ ঠিক তখনই বিস্ফোরণের শব্দ৷ দূরে ধোঁয়া আর আগুনের শিখা৷ আমার চারপাশের ভবনের কাঁচ, জানালা সব ভেঙে পড়ছিল৷ আমি দ্রুত একটি গাছের নিচে আশ্রয় নেই,” বললেন সুজন ৷

কিছুক্ষণ পর বিস্ফোরণের শব্দ থেমে গেলে তিনি শোরুমে যান৷ গিয়ে দেখেন শোরুমটি ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছে৷ তিনি তার রুমমেট মেহেদির আহত হওয়া ও হাসপাতালে নেয়ার খবর পান৷ পরে মেহেদি মারা যান৷ তার অফিস থেকে মেহেদির অফিস দুই মিনিটের হাঁটা পথ৷ সুজন বলেন, ‘‘ওই ভবনে আরো অনেকে ছিলেন ৷ তাদের অধিকাংশ বের হতে পারলেও মেহেদি বের হতে পারেনি৷ সম্ভবত কাঁচ ভেঙে পড়ায় তার আঘাতে সে মারা যায় ৷”

মেহেদীর পরিবার সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪ সালে সুদে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ করে লেবাননে পাড়ি দেন মেহেদী । সেখানে একটি বিপণিবিতানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতেন। এরপর আর দেশে আসা হয়নি। ঋণের পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে সুদসহ তিন লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন মেহেদী। তার বাড়িতে এখন শোকের মাতম।

কান্নাজড়িত কন্ঠে বাবা তাজুল ইসলাম ফোনে বলেন, “আমি বাহরাইনে যাওয়ার সময় মেহেদী বিদায় জানিয়েছিল। ১২ বছর আগে সেটাই ছিল শেষ দেখা। এরপর প্রায় ১২ বছর ধরেই ছেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই।’

‘লেবাননে বাংলাদেশি টাকায় ২০ হাজার টাকার মতো আয় ছিল মেহেদীর। তা থেকে থাকা–খাওয়ার খরচও চালিয়ে দেশে টাকা পাঠাতে কষ্ট হতো তার। গত কয়েক ৭/৮ মাস ডলারে দাম বেড়ে যাওয়াও কষ্ট আরও বাড়ে। তারপরও কয়েক মাস পরপর ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পাঠাতেন পরিবারের জন্য”-বলেন মেহেদী বাবা।

আগের খবর : বৈরুত বিস্ফোরণ-নিহত দুই বাংলাদেশি, আহত অর্ধশতাধিক

তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন জিয়াসমিন আক্তার। দূরপরবাসে থাকায় মেহেদী নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন প্রিয় বোনের সঙ্গে। ফোনে জিয়াসমিন বলেন, প্রতিদিন কাজে যাওয়ার আগে ভাই আমাকে ভিডিও কল দিতেন। কথা বলতেন। এখন ১১টা বাজলেই ভাইয়ের কথা মনে পড়বে। ১১টা বাজলেও আর ভাইয়ের ফোন আসবে না। ছয় বছর ধরে ভাইকে দেখি না। ভাইয়ের মরদেহটাও দেখতে পারব কিনা জানি না?’

মরদেহ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য সরকার ও বাংলাদেশ দূতাবাসের র সহায়তা চেয়েছেন মেহেদীর পরিবার।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!