নারী দিবসে তিন রাষ্ট্রদূতের গল্প

সারা বিশ্বের বাংলাদেশি কূটনীতিকদের মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিদেশের মিশনগুলোতে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী কর্মকর্তা কাজ করছেন। এদের মধ্যে বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের আটজন নারী রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। স্বাধীনতার পর একসাথে এত সংখ্যাক বাংলাদেশি নারীর বিদেশি মিশনগুলোর দায়িত্ব পালন করার ঘটনা একটি মাইলফলক ও রেকর্ড বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় মেধাতালিকার শীর্ষে অবস্থান নিয়ে পররাষ্ট্র ক্যাডারে যোগ দেওয়া এসব কর্মকর্তা কর্মক্ষেত্রে প্রতিমুহুর্তেই রাখছেন যোগ্যতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদেশ মিশনে নিয়োজিত নারী রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের মধ্যে রয়েছেন, যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনীম, জাতিসংঘে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা, ভিয়েতনামে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ, নেপালে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস, মরক্কোতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা, মরিশাসে হাইকমিশনার রেজিনা আহমেদ, দক্ষিণ কোরিয়ায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম ও জর্ডানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান।

বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারি এসব কর্মকর্তা নারী জীবনকে ছাপিয়ে চ্যালেঞ্জ নিয়ে সফল কূটনৈতিক হিসেবে আলো ছড়াচ্ছেন। তেমনই কিছু গল্প আর চ্যালেঞ্জের কথা জানতে দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও জর্ডানে নিযুক্ত তিন নারী রাষ্ট্রদূতের সাথে কথা বলেছে আকাশযাত্রা। এবারের নারী দিবসে ঈর্ষণীয় সাফল্যের এই তিন নারীকে নিয়েই আমাদের আয়োজন।

Travelion – Mobile

আবিদা ইসলাম, রাষ্ট্রদূত, দক্ষিণ কোরিয়া
“রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমাকে দেখে, তারা বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়নের কথা উল্লেখ করেন”

দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আবিদা ইসলাম কর্মরত আছেন ২০১৭ সাল থেকে। পেশাদার কূটনীতিক আবিদা ইসলাম বিসিএস ১৫তম ব্যাচে ফরেন অ্যাফায়ার্স ক্যাডার হিসেবে যোগ দেন। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন ছাড়াও কলকাতায় উপ হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

 দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট  মুন জে ইন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম

এছাড়াও লন্ডন, কলম্বো, ব্রাসেলস মিশনে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। আবিদা ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি ফরেন অ্যাফেয়ার্স ও ট্রেড বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সেমিনার এবং সামিটে বাংলাদেশ প্রতিনিধিত্ব করেন।

আকাশযাত্রার সাথে কথা হলে রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম বলেন, “নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে।. World Economic Forum এর মতে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সব গুলো দেশ থেকে এগিয়ে রয়েছে । পৃথিবীর ১৫৩ টি দেশের মধ্যে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের যে অসাধারণ অগ্রগতি ঘটেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।”

তিনি বলেন,”বাংলাদেশে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা তাদের মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন এবং উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন। তবে নারীদের জন্য আলাদা একটি দিবস মানে একথাটা আমাদের মানতে হবে যে নারীরা এখনো অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছেন।”

“সমঅধিকার,সমান সুযোগ, সমান বেতন কাঠামো ইত্যাদির জন্য তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তবে তারপরে ও বলবো যে সব কিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশ নারী ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত”,আবিদা ইসলাম যোগ করেন।

একজন নারী এগুলে সমাজ এগুবো,পরিবারে আমূল পরিবর্তন হয় জানিয়ে তিনি বলেন,“নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন প্রতিযোগিতা নয়, পুরুষরাও নারীদের মিত্র। আমি কূটনীতিক হিসেবে পরিবার, সহকর্মী, সন্তান সকলের প্রাণখোলা সহযোগিতা পেয়েছি।”

তিনি আরো বলেন,“রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনে বিস্মিত হয়ে দেখেছি, দক্ষিণ কোরিয়ার কোন অনুষ্ঠানে যখন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করি, বাংলাদেশের নারী রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমাকে দেখে, তারা বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়নের কথা উল্লেখ করেন।”

সামিনা নাজ, রাষ্ট্রদূত, ভিয়েতনাম
“নারী পুরুষ উভয়ের ঐকান্তিক প্রাণোচ্ছেল স্বপ্নে বিশ্ব এগিয়ে যাবে”
সামিনা নাজ ভিয়েতনামের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ২০১৭ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর আগে তিনি মুম্বাইতে বাংলাদেশের উপহাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিসিএস (পররাষ্ট্র ক্যাডার) ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা সামিনা নাজ ১৯৯৫ সালে পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে কাজে যোগ দেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি নিউইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন, দিল্লি ও নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

 ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ
ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ

নারী দিবসে আকাশযাত্রাকে সামিনা নাজ বলেন, “বৈশ্বিক পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে তাদের মেধা, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে। বাংলাদেশে নারীরা কূটনীতি থেকে শুরু করে সকল পেশার তাদের স্বাক্ষর রেখেই চলেছেন।

কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকাদের নারী-পুরুষের কোন আলাদা পরিচয় থাকা উচিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “যে কোন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে পুরুষ যে কাজ করে, নারীও একই কাজ করতে পারে। তাই এই জায়গায় জেন্ডার নির্ণয়ের প্রশ্নই আসে না। উভয়ের কাজ একই।”

বর্তমান বাংলাদেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও একজন সফল নারী, সফল রাষ্ট্রনায়ক তিন তিন বারের রাষ্ট্র নায়ক, তিনি শুধু আমাদের অনন্য নারী মডেল নন, একই সাথে বিশ্ব নারী ক্ষমতায়নের উজ্জ্বল নক্ষত্র।”

নারীর জীবনে পুরুষের সমর্থনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে সামিনা নাজ আরও বলেন, “একথা সত্যই আশরাফুল মাখলুকাত সৃষ্টির সেরা মানুষ আমরা,সৃষ্টিকর্তা নারী পুরুষ উভয়ের মাঝে আলাদা অবয়ব তৈরী করে পাঠিয়েছেন। সে হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আলাদা, আমাদেরকে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব ও পারিবারিক দায়িত্ব ভারসাম্যতা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হয়।”

”দেখুন পররাষ্ট্র দপ্তরে যখন থেকে চাকরি করি তখন থেকে আমাকে সাহস যুগিয়েছেন, উৎসাহ উদ্দীপনা প্রেরণা দিয়েছেন আমার পিতা, তিনি চাইতেন আমি যেন কূটনীতিক হই। এতটুকু আসার পেছনে পরিবার, স্বামী, সন্তান, সহকর্মী সকলের সহযোগিতা পেয়েছি অবরাতি চিত্তে”, বলেন সামিনা নাজ।

সবশেষে তিনি যোগ করেন, “বলতে দ্বিধা নেই, কূটনীতিক হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, বৈমানিক হিসেবে, রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেই চলেছেন নারীরা। নারী পুরুষ উভয়ের ঐকান্তিক প্রাণোচ্ছেল স্বপ্নে বিশ্ব এগিয়ে যাবে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সেই প্রত্যাশা করি।“

নাহিদা সোবহান, রাষ্ট্রদূত, জর্ডান
“বাংলাদেশে নারী-পরুষের সমতা অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি”
বাংলাদেশের বিদেশি মিশনগুলোতে কর্মরত নারীদের মধ্যে সবশেষ নিয়োগ পাওয়া হলেন নাহিদা সোবহান। তিনি এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে জর্ডান দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে নাহিদা সোবাহান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘ অনুবিভাগের মহাপরিচালক ছিলেন। ১ মার্চ জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আল-হুসাইনের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করেন নাহিদা সোবহান।

জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ আল হাসোইনের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করেছেন নবনিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান
জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ আল হাসোইনের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করেছেন নবনিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান

১৫তম বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের এই কর্মকর্তা এর আগে রোম, কলকাতা ও জেনেভায় অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষাজীবনে নাহিদা সোবহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক(সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি নেদারল্যান্ডসের হেগের একাডেমি অফ ইন্টারন্যাশনাল ল-এ পাবলিক ইন্টারন্যাশনাল আইন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। এছাড়া ফ্রান্সের প্যারিসের পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইনস্টিটিউট থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করেন।

নারী দিবসে আকাশযাত্রাকে নাহিদা সোবহান বলেন, “এই নারী দিবসে সকল নারীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। পাশপাশি সেসব পুরুষকে আমার শ্রদ্ধা জানাচ্ছি যারা তাদের কন্যা সন্তানকে যথাযথ ভালবাসা ও সম্মানের সাথে লালন করেন।”

তিনি বলেন, “কূটনীতিক হিসেবে একজন পুরুষ যেই ভূমিকা পালন করবেন নারীও ঠিক একই ভূমিকা রেখে দেশ ও জনগণের স্বার্থে কাজ করে যাবেন। তাই দেশপ্রেমের প্রশ্নে পুরুষ ও মহিলা কূটনীতিকরা সমান, কারণ তারা সমান দেশপ্রেম নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেন।”

তবে মহিলা কূটনীতিকদের জন্য এই দায়িত্বটা কিছুটা বেশি চ্যালেঞ্জিং জানিয়ে তিনি বলেন,“কূটনীতির সাথে আমাদের পরিবারের যত্নও নিতে হয়। তাই চ্যালেঞ্জটাও বেশি। তবে একজন মহিলা কূটনীতিক হওয়ায় আমি অনুভব করি যে বাংলাদেশী মহিলা প্রবাসীরা কোনও সমস্যায় পড়লে আমার সাথে কথা বলতে আরও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাই আমি তাদের সেবা করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব।”

তিনি আরও বলেন,“নারী দিবস পালনের সময় আমাদের উচিত সেসব পুরুষ সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব ও স্বজনদের সাধুবিাদ জানানো যারা নারীদের অধিকারের পক্ষে দাড়ায়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমি আমাদের অনেক পুরুষ সহকর্মীদের দেখেছি যারা তাদের মহিলা সহকর্মীদের যথাযথ সম্মান ও সমর্থন দেন। তবে আমি মনে করি সেই সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা আরও বিস্তৃত হওয়া উচিত।”

এসময় তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে নারী-পরুষের সমতা অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি নিশ্চিত হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।

এই তিন সফল কূটনীতিক বলেছেন, নারীর উন্নয়নে পুরুষের অনেক ভূমিকা আছে। নারীর বিরুদ্ধে বর্বর আচরণ ও সহিংসতা দূর করতে হবে । এক্ষেত্রে শিক্ষার ব্যাপক ভূমিকা আছে।”

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!