কূটনীতিতে নারীর জ্যোতি

বর্তমানে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে আট নারী রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন। তারা প্রত্যেকেই পেশাদার কূটনীতিক। শুধু তা-ই নয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৩ সচিব পদের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদেও দায়িত্ব পালন করছেন একজন নারী কূটনীতিক।

বর্তমানে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন রাবাব ফাতিমা, যুক্তরাজ্যে রয়েছেন হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনীম, পোল্যান্ডে রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা, মরিশাসে হাইকমিশনার রেজিনা আহমেদ, দক্ষিণ কোরিয়ায় রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম, ভিয়েতনামে রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ, জর্ডানে রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান এবং ব্রুনাইতে হাইকমিশনার নাহিদা রহমান সুমনা। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান ও যোগ্যতায় বড় সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন।

রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার ছাড়াও অনেক নারী বিদেশি মিশনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে একজন কন্সাল জেনারেল, ৫ জন উপ-রাষ্ট্রদূত বা মিনিস্টার পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। কনসাল জেনারেল হিসেবে নিউ ইয়র্কে সাদীয়া ফয়জুন্নেছা, ওয়াশিংটনে মিশন উপ-প্রধান ফেরদৌসি শাহরিয়ার, থাইল্যান্ডে মিনিস্টার পদে শাহনাজ গাজী, ইন্দোনেশিয়ায় কাজী আনারকলি, জেনেভা মিশনে সঞ্চিতা হক এবং নেপালে মিনিস্টার পদে ইসরাত জাহান দায়িত্বে রয়েছেন।

Travelion – Mobile

এছাড়া কাউন্সেলর, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সচিব পদে আরো অন্তত ৩০ নারী কূটনীতিক দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন উইংয়ে কর্মরত আরো ৫৩ জন নারী কূটনীতিক। যার মধ্যে সচিব (পূর্ব) ছাড়াও আছেন মহাপরিচালক পদে ৪ জন, পরিচালক পদে ১৩ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ৯ জন এবং সহকারী সচিব এবং ট্রেইনি মিলে আরো ২৮ জন নারী কর্মকর্তা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ৩ শতাধিক কূটনীতিকের প্রায় এক তৃতীয়াংশই এখন নারী।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসিলম রাজা-বাদশাদের দেশগুলোতেো বাংলাদেশ নারী কূটনীতিক পাঠাচ্ছে, এমনকি রাষ্ট্রদূত/ হাইকমিশনারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও। গত বছর অক্টোবরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডানে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের একজন নারী রাষ্ট্রদূত নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি হলেন নাহিদা সোবহান। অন্যদিকে ব্রুনাইতেও বাংলাদেশের প্রথম নারী হাইকমিশার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন নাহিদা রহমান সুমনা। রাজা-বাদশাদের দপ্তরের হাজিরা দিয়ে তারা বাংলাদেশ ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বার্থ সংরক্ষণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা এবং পররাাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) এখন দেশের সবচেয়ে সিনিয়র নারী কূটনীতিক। রাবাব ফাতিমা ১৯৮৯ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। তার আগে দেশে মাত্র চার জন্য নারী কূটনীতিক ছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ও জাতিসংঘ প্রকল্প সেবাসমূহের কার্যালয়ের (ইউএনওপিএস) নির্বাহী বোর্ডের সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। গত বছর থেকে তিনি ইউনিসেফ নির্বাহী বোর্ডের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন।

মাশফি বিনতে শামস ১৯৯১ সালে মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। নেপালে ৫ বছর রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব শেষে দেশে ফিরে তিনি চলতি বছর থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) হিসেবে কাজ করছেন। সার্ক সদর দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয়, কূটনীতিক সর্ম্পক জোরদার, নেপালে ইউএস বাংলার বিমান দূর্ঘটনাসহ নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রথম স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ইসমত জাহান (বামে), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস (ডানে)
জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রথম স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ইসমত জাহান (বামে), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস (ডানে)

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে ১৯৭৯ সালে পররাষ্ট্র সার্ভিস ক্যাডার থেকে প্রথম নারী কূটনীতিক হিসেবে যোগ দেন নাসিম ফেরদৌস। ২৩ বছর পর তাকে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত করা হয়। রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি দেশের দ্বিতীয় নারী। এর আগে ১৯৯৬ সালে প্রথম রাষ্ট্রদূত করা হয় মাহমুদা হক চৌধুরীকে। তবে তিনি পেশাদার কূটনীতিক ছিলেন না। তিনি দুই বছর ভুটানে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর নাসিম ফেরদৌস, নাসিমা হায়দার, সেলিনা মোহসিন, মাজেদা রফিকুন্নেসাসহ অনেক নারী রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার হয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। রাষ্ট্রদূত ইসমত জাহান নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রথম স্থায়ী প্রতিনিধি এবং পাশাপাশি প্রথম মহিলা সিনিয়র সচিব ছিলেন। তিনি লিয়েনে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ওআইসির রাষ্ট্রদূতেরও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সম-সাময়িকদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার ছিল ’৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তার।

নারী কূটনীতিকদের অগ্রযাত্রার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শনা অনুযায়ী আমরা নারীদের প্রাধান্য দিতে চাই। সে কারণে বিভিন্ন মিশনে নারী কূটনীতিকদের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই ধারা আমরা অব্যাহত রাখব। এখন অনেক মিশনে নারী রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার রয়েছেন। আগামী দিনেও বিভিন্ন মিশনে নারী কূটনীতিকদের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হবে প্রত্যাশা করি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে পুরুষ কূটনীতিকের পাশাপাশি নারী কূটনীতিকের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে জোর দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে যেসব নারী বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন প্রত্যেকেই যোগ্যতা দিয়েই রাষ্ট্রদূত কিংবা হাইকমিশনারের পদে আসীন হয়েছেন। তারা সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জল করছেন।

বিদেশি মিশনে নারী কূটনীতিকদের অংশগ্রহণ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন দক্ষিণ কোরিয়ায় রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম ‘নারী কূটনীতিকদের সংখ্যা বাড়ছে, এটা আশাব্যঞ্জক ও উৎসাহব্যাঞ্জক। রাষ্ট্রদূতের বাইরে বিভিন্ন মিশনে বড় বড় পদে নারী কূটনীতিকও আছেন। মন্ত্রণালয়ে গেলে তো দেখা যায়, বিভিন্ন পদে নারী কূটনীতিকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আমাদের দেশ নারীর ক্ষমতায়নের রোড মডেল।’

তিনি আরও বলেন,আজো যখন নারীদের জন্য আলাদাভাবে একটি দিবস পালন করা হচ্ছে- তার অর্থই হচ্ছে সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারীদের অধিকার এখনো সম-অধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন সমাজে বর্তমানে নারীদের সুযোগ- সুবিধা বেড়েছে, তাদের অধিকার, সম্মান এবং মর্যাদা বেড়েছে। কিন্তু নানা ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি অসমতা এবং অর্থনৈতিক বঞ্চনা এখনো রয়ে গেছে। যেমন কাজের ক্ষেত্রে সমান মজুরি নিশ্চিত করা, সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তাছাড়া, ঘরে-বাইরে নারীরা সহিংসতা, যৌন নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছেন। ১৯১০ সালের ৮ই মার্চ প্রথম নারী দিবস পালিত হয়েছিল। ১১০ বছর পরেও আমরা নারী দিবস পালন করছি- হয়ত এমনিভাবে আরো অনেক বছরের প্রয়োজন হবে নারীদের সমতার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে।

ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা আকাশযাত্রাকে বলেন, “বৈশ্বিক পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে তাদের মেধা, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে কূটনীতি থেকে শুরু করে সকল পেশার তাদের স্বাক্ষর রেখেই চলেছেন।

নারীর জীবনে পুরুষের সমর্থনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে সামিনা নাজ আরও বলেন, “একথা সত্যই আশরাফুল মাখলুকাত সৃষ্টির সেরা মানুষ আমরা,সৃষ্টিকর্তা নারী পুরুষ উভয়ের মাঝে আলাদা অবয়ব তৈরী করে পাঠিয়েছেন। সে হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আলাদা, আমাদেরকে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব ও পারিবারিক দায়িত্ব ভারসাম্যতা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হয়।”

জর্ডানের রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান বলেন, আজকের এই দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই দিবসের মর্মকথা এমনটি হবে সমাজ নারীকে আলাদা চোখে দেখবে না, তাদেরকে সমকক্ষ ও সমানচোখে দেখবে,একজন সহযোগীপূর্ণ মানুষ হিসেবে ভাববে। মানুষ হিসেবে নারী পুরুষ সকলে সমান, অভিন্ন তরী । আমি মনে করি নারী দিবস আবশ্যিকভাবে সামাজিক পরিবর্তনে বিশেষ সহায়ক। সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে, এবং চিন্তার পরিবর্তনে নারী দিবস খুবই তাৎপর্যে রাখে। আমাদের জীবনের প্রতিটি দিনই মা, বোন ও কন্যাদের উপলক্ষ্যে উদযাপন করার মত একটি দিন। ৮ই মার্চের আন্তর্জাতিক নারী দিবস আমাদের সেটাই মনে করিয়ে দেয়। এই দিনটি আমাদের জীবনে কার্যতভাবেই নারীদের অর্জন এবং অবদানগুলোকে উদযাপন করতে সবাইকে উৎসাহিত করে।

ব্রুনাইতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার নাহিদা রহমান সুমনা বলেন, আমার কাছে প্রতিদিন নারী দিবস। আমি মনে করি, নারী হোক পুরুষ হোক আমরা এই ধরণীর মানুষ। সুতরাং বিশেষ কোন দিন নই, সোজা কথায় ৩৬৫ দিনই নারী দিবস, প্রতিটি দিন সমান।

বর্তমান সময়ে নারীদের অবদানকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন, সভ্যতার এই বিকাশে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে নারীরা তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখছে, যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছে। এমন কোন পরিসর নেই যে পরিসরে নারীর অবদান নেই। লিডারশিপে নারী থাকায় সমাজে নারীরা এগিয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীদেরকে নেতৃত্বের সুযোগ দিচ্ছেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!