এয়ারবাস এ ৩২১ এক্সএলআর, দূরের যাত্রার নতুন মাইলফলক

বিগত কয়েক দশকে দূরপাল্লার উড়োজাহাজে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। এরমধ্যে প্রথম মাইলফলক ধরা হয় ১৯৭০ সালে বোয়িং ৭৪৭ এবং একই ধরনের বেশি যাত্রী ধারণে সক্ষম বিশালাকার উড়োজাহাজের আগমনকে। এসব উড়োজাহাজ অনেক দূরপাল্লার রুটের দুয়ার উন্মুক্ত করে এবং এভিয়েশনের অর্থনীতির হিসেব পাল্টে দেয়।

সাম্প্রতিক সময়ে এয়ারবাস এ৩২১ এক্সএলআর এভিয়েশনে আসার মধ্য দিয়ে দূরপাল্লার ফ্লাইটে আরেকটি মাইলফলক রচিত হয়েছে। সরু আকৃতির বডির এই উড়োজাহাজের দূরপাল্লায় উড়ার ক্ষমতা এই খাতের বাজার এবং অর্থনীতির উপর বেশ প্রভাব ফেলবে বলেই এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

এয়ারবাস এ ৩২১এক্স এল আর হল এয়ারবাস এ ৩২০ নিও পরিবারের একটি অতি দূরপাল্লার আকাশযান। এ ৩২০ নিও ২০১০ এ যাত্রা শুরু করে, যা এ ৩২০ পরিবারের অন্য উড়োজাহাজগুলোর তুলনায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি জ্বালানি ধারণ করতে পারে। এই আকাশযান সর্বোচ্চ ২৪০ জন যাত্রীবহনক্ষম উড়োজাহাজটি ৭ হাজার ৪’শ কিলোমিটার (৪ হাজার নটিক্যাল মাইল) পর্যন্ত উড়তে পারবে। অবশ্য দীর্ঘ দুরত্বে সর্বোচ্চ ২০৬ যাত্রী নিতে পারবে।

Travelion – Mobile

২০১৯ এর জুনে এয়ারবাস এ ৩২১এক্স এল আর এর আগমনের মধ্য দিয়ে আকাশযান শিল্পের অগ্রগতি অনন্য উচ্চতায় গিয়ে ঠেকে। দূরপাল্লার এই সরু অবকাঠামোর আকাশযানটি খুব দ্রুতই বেশ জনপ্রিয়তা পায়। প্রথম কয়েকমাসেই এটি বিভিন্ন উড়ানসংস্থা থেকে বিশাল পরিমাণ অর্ডার পেয়ে বেশ সাড়া ফেলে দেয়। এ ছাড়া বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স এর অকোজো পড়ে থাকার বিপরীতে এই সাড়া বোয়িং আর এয়ারবাসের প্রতিযোগিতায় নতুন মাত্রা যোগ করে। সবমিলিয়ে ২০১৯ সালের এভিয়েশনের গেমচেঞ্জার ছিল এয়ারবাস এ ৩২১ এক্সএলআর।

২০১৯ এর জুনে প্যারিস এয়ার শো’তে এয়ারবাস এ ৩২১ এক্সএলআর এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও এটির সরবরাহ শুরু হবে ২০২৩ সালে। এটি চালু হতে হতে এই শিল্পে আরো অনেক অগ্রগতি সাধিত হবে তবুও এই ২০১৯ সালটি দূরপাল্লার উড়োজাহাজের অগ্রগতিতে একটি মনে রাখার মত বছর হয়ে থাকবে।

এয়ারবাস দূরপাল্লার এ ৩২১ এল আর এর সূচনা করে ২০১৫ সালে। সাধারণের চেয়ে ফুয়েল ধারণে সক্ষম এই উড়োজাহাজের উড্ডয়ন ক্ষমতা ৭৪০০ কি.মি বা ৪০০০- নটিক্যাল মাইল যা এ ৩২১ পরিবারের অন্যান্য উড়োজাহাজ থেকে ৯৩০ কিমি বেশি।

২০১৮ এর জানুয়ারিতে এয়ারবাস তাদের এই নতুন উড়োজাহাজ এ ৩২১এক্স এল আর কথা জানায়। এটি এয়ারবাস এ ৩২১ এল আর মতই একই রকম পাখা আর ইঞ্জিনে সজ্জিত। পার্থক্য কেবল অতিরিক্ত জ্বালানি আর এই বাড়তি জ্বালানির ওজনের কারণে আরো মজবুত করা ল্যান্ডিং গিয়ার ।

শুরু থেকেই এই আকাশযানটি বিপুল পরিমাণ অর্ডার পেয়ে চমক দেখিয়েছে। প্যারিস এয়ার শো’তে মিডল ইস্ট এয়ারলাইন্স (MEA) ছিল এই উড়োজাহাজের প্রথম ক্রেতা, যারা মোট চারটি উড়োজাহাজ অর্ডার করেছে। এই শো’তে আমেরিকান এয়ারলাইন্স ৫০ টি এয়অরবাস এ ৩২১এক্সএলআর এর অর্ডার দেয় যদিও এরমধ্যে ৩০ টি হল এ ৩২১ নিও উড়োজাহাজের পরিবর্তিত অর্ডার। এ থেকে ধরে নেয়া যায়, উড়ানসংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে সামান্য বেশি খরচে আরো উন্নতমানের উড়োজাহাজ পাওয়ার ব্যাপারটি এখানে কাজ করেছে।

ভারতীয় ইন্ডিগো পরিবার থেকে ৫০ টি অর্ডার এসেছে যা তাদের তিনটি উড়ানসংস্থা উইঝ (Wizz) এয়ার, জেটস্মার্ট এবং ফ্রন্টিয়ারের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। আইএজি পরিবার চেয়েছে ১৪টি আকাশযান যার ৮টি ইবেরিয়া আর ৬টি অ্যায়ের লিংগাসের মধ্যে বন্টিত হবে।

ভারতীয় ইন্ডিগো পরিবার  ৫০ টি এয়ারবাস এ ৩২১ এক্সএলআর উড়োজাহাজের অর্ডার  দিয়েছে। ছবি : এয়ারবাস
ভারতীয় ইন্ডিগো পরিবার ৫০ টি এয়ারবাস এ ৩২১ এক্সএলআর উড়োজাহাজের অর্ডার দিয়েছে। ছবি : এয়ারবাস

প্যারিস এয়ার শো’তে কোয়ান্টাসের পক্ষ থেকেও অর্ডার দেয়া হয়েছে ৩৬ টি এয়ারবাস এ৩২১ এক্স এল আর এবং ২৮ টি এ ৩২১ এল আর আকাশযান। এশিয়ার সাশ্রয়ী উড়ানসংস্থা এয়ার এশিয়াও অর্ডার করেছে ৩০ টি উড়োজাহাজ। মার্কিন উড়ানসংস্থা জেট ব্লু দিয়েছে ১৩ টি উড়োজাহাজের অর্ডার।

দুবাই এয়ার শো’তে এয়ার এরাবিয়া এয়ারবাসের সাথে তাদের ১২০ টি উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি অনুযায়ী ২০ টি এ ৩২১ এক্স এল আর অর্ডার করে। এই শো’তে সাউদি এরাবিয়ান সাশ্রয়ী উড়ানসংস্থা ফ্লিনাস ১০ টি এ ৩২১ এক্স এল আর বুকিং করে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম উড়ানসংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড এয়ার তাদের বহরে ৫০ টি নতুন এই উড়োজাহাজ যুক্ত করার চুক্তি করে। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইউনাইটেডের নির্ভরতার পাল্লা বোয়িং থেকে সরে আসবে সন্দেহ নেই। ডিসেম্বরে চিলির সাশ্রয়ী উড়ানসংস্থা স্কাই ১০ টি নতুন এই এয়ারবাস কেনার ঘোষণা দেয় যা তাদের আন্তর্জাতিক রুটে উড়োজাহাজ চলাচল বাড়ানোর পরিকল্পনার অংশ।

সাম্প্রতিক ঘোষণাটি এসেছে এয়ার মাল্টা থেকে। তারা ২০২৪ এ তাদের বহরে নতুন দুটি এয়ারবাস এ৩২১ এক্স এল আর যুক্ত করার পরিকল্পনা করেছে।

সুচনার বছরেই অর্ডারের এমন সাড়া ও পরিসংখ্যান দেখে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক নতুন এই আকাশযানটি এত দ্রুত কিভাবে জনপ্রিয়তা পেল? এর পেছনে অনেকগুলো কারণ ওঠে এসেছ। অন্যান্য সরু আকৃতির আকাশযানের উড্ডয়ন স্থায়ীত্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এয়ারবাস এ ৩২১ এক্সএলআর অনায়াসে কয়েকধাপ এগিয়ে। এটির বৈশিষ্ট্য অনেক উড়ানসংস্থার চাহিদার সাথে একেবারে মিলে যায়। এটি একইসাথে দূরপাল্লায় উড্ডয়নের সুবিধা ও ছোট এয়ারপোর্টে সরু আকৃতির উড়োজাহাজের চাহিদাও পূরণ করে যা উড়ানসংস্থাগুলোর জন্য লুফে নেয়ার মত ব্যাপার।

অনেক উড়ানসংস্থার নতুন বিনিয়োগের অন্যতম লক্ষ্য থাকে নতুন নতুন রুটে আরো ফ্লাইট পরিচালনা করা। যেমন, আমেরিকান এয়ারলাইন্স নতুন এই উড়োজাহাজের মাধ্যমে ইউরোপের অনেক শহর থেকে তাদের পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলের কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সংযোগ ঘটাতে পারবে।

কম খরচের বিমানসংস্থা এয়ার এশিয়া, উইজার এবং জেট ব্লু তাদের বহরে বড় আকারের উড়োজাহাজের কেনার ঝামেলায় না গিয়েও দূরপাল্লার এই সরু আকারের উড়োজাহাজের যোগ করতে পারবে। এয়ারবাস এ৩২১ এক্স এল আর থেকে আরেকটি উড়ানসংস্থা আইসল্যান্ড এয়ারও বেশ উপকার পাবে। এই আকাশযানটি তাদের স্বল্প-পাল্লার রুটের চাহিদা মিটিয়ে নতুন নতুন রুটের সূচনা করতে পারে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!