ইউরোপের দেশে দেশে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, সংঘর্ষ

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে নতুন করে আরোপ করা বিধিনিষেধের প্রতিবাদে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আংশিক লকডাউন ঘোষণার প্রতিবাদে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে নেদারল্যান্ডসে। রোববার রাস্তায় নেমে এসেছেন বেলজিয়ামের নাগরিকেরা। একই ধরনের বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হচ্ছে অস্ট্রিয়া, ক্রোয়েশিয়া, ফ্রান্স ও ইতালিতেও।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি ইউরোপে নতুন করে করোনার প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। কোনো কোনো দেশে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত শনিবার যুক্তরাজ্য সরকারের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, শুধু ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে ৪০ হাজার ৯৪১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। সংক্রমণ বাড়ার এমন হার ইউরোপের বেশ কিছু দেশে। ফলে সেখানকার বিভিন্ন দেশে আরোপ করা হচ্ছে নতুন বিধিনিষেধ।

ওয়াল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, রোববার ২৪ ঘণ্টায় যুক্তরাজ্যে ৪০ হাজার ৪ জন, নেদারল্যান্ডসে ২০ হাজার ৯৬৬ জন, ফ্রান্সে ১৯ হাজার ৭৪৯ জন, ইতালিতে নয় হাজার ৭০৯ জন ও ক্রোয়েশিয়ায় চার হাজার ২০২ জনের করোনা শনাক্ত হয়।

নেদারল্যান্ডসে আংশিক লকডাউন ঘোষণার প্রতিবাদে অব্যাহত বিক্ষোভে রটারডামে একটি মোটরসাইকেলে বিক্ষোভকারীদের অগ্নিসংযোগ। ছবি: রয়টার্স
নেদারল্যান্ডসে আংশিক লকডাউন ঘোষণার প্রতিবাদে অব্যাহত বিক্ষোভে রটারডামে একটি মোটরসাইকেলে বিক্ষোভকারীদের অগ্নিসংযোগ। ছবি: রয়টার্স

নেদারল্যান্ডস
আংশিক লকডাউন ঘোষণার প্রতিবাদে নেদারল্যান্ডসে গত শুক্রবার বিক্ষোভ শুরু হয়। শনিবার রাতে দ্য হেগসহ বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ জানাতে রাজপথে নেমে আসেন মানুষ। প্রথম দিনের মতো এদিনও পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। দেশটিতে এ প্রতিবাদ এখনো অব্যাহত রয়েছে।

Travelion – Mobile

শনিবার নেদারল্যান্ডসে তিন সপ্তাহের আংশিক লকডাউন ঘোষণা করা হয়। বলা হয়েছে, সোমবার রাত আটটার মধ্যে সব বার ও রেস্তোরাঁ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজনে জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

শনিবার রাতে দাঙ্গা দমনকারী পুলিশের সদস্যরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে এসে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিক্ষোভকারীরা তখন হেগ শহরের রাস্তায় কিছু বাইসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন। পুলিশকে পটকাও ছুড়ে মেরেছেন তাঁরা। শহরটিতে জরুরি আদেশ ঘোষণা করেছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় কমপক্ষে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, বিক্ষোভকারীদের কেউ একজন একটি অ্যাম্বুলেন্সের জানালায় পাথর ছুড়ে মেরেছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তারা টুইটারে জানিয়েছেন, শনিবারের সহিংসতায় পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।

এর আগে শুক্রবার নেদারল্যান্ডসের রটারডাম শহরে বিক্ষোভে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এদিন বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ছুড়েছে পুলিশ। পুলিশের এক মুখপাত্র দাবি করেছেন, শুক্রবারের ঘটনায় প্রাণনাশের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এ কারণে সতর্কতা গুলি ও সরাসরি গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। এদিন অন্তত তিন বিক্ষোভকারী গুলিবিদ্ধ হন।

বেলজিয়াম
করোনা সংক্রমণ রোধে বেলজিয়ামে মাস্ক ব্যবহারের বিধিতে কড়াকড়ি করা হয়েছে। দেশটিকে আগে থেকেই রেস্তোরাঁর মতো জায়গাগুলোতে ‘কোভিড পাস’ লাগত। কিন্তু কোভিড পাসের পরও নতুন করে মাস্ক ব্যবহারে কঠোর বিধি আরোপ করা হয়েছে। এর বাইরে দেশটিতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত অধিকাংশ বেলজিয়ানিদের সপ্তাহে চার দিন বাসায় থেকে অফিসের কাজ করতে বলা হয়েছে। গত বুধবার নতুন করে এই ঘোষণা আসে। দেশটিতে সব স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য করোনার টিকা বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে সরকার।

সবকিছু মিলিয়ে দেশটির নাগরিকেরা এসব বিধিনিষেধ মানতে চাইছেন না। রোববার এর প্রতিবাদে রাজধানী ব্রাসেলসে হাজার হাজার মানুষ এক পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিল। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, পথে পুলিশ প্রতিবাদকারীদের ওপর জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ সময় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ বেশ কয়েজনকে আটক করে।

বেলজিয়ামের পুলিশ জানিয়েছে ওই কর্মসূচিতে ৩৫ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছিল। তারা ব্রাসেলসের নর্থ স্টেশন থেকে পদযাত্রা শুরু করেছিল।

অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় করোনা বিধি-নিষেধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীরা পতাকা ও প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে রাস্তায় জড়ো হন। ছবি: রয়টার্স
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় করোনা বিধি-নিষেধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীরা পতাকা ও প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে রাস্তায় জড়ো হন। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রিয়া
অস্ট্রিয়ার সরকার সোমবার থেকে দেশটিতে ২০ দিনের পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করার একদিন পর শনিবার রাজধানী ভিয়েনায় হাজার হাজার মানুষ করোনার বিধি-নিষেধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন। সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির থেকে সবার জন্যে ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করেছে।

ভিয়েনার প্রাক্তন সাম্রাজ্যবাদী প্রাসাদ হফবার্গের সামনে হিরোস স্কোয়ারে বিক্ষোভকারীদের ভিড় ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও আরও অনেক জায়গায় প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। অনেক বিক্ষোভকারীর হাতে অস্ট্রিয়ার পতাকা ছিল। কারো কারো হাতের পোস্টারে বিভিন্ন স্লোগান লেখা ছিল। পুলিশ জানিয়েছে, দুপুরের মধ্যে ভিড় বেড়ে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের জটলা হয়। তারা হফবার্গের দিকে যাওয়ার আগে ভিয়েনার অভ্যন্তরীণ রিং রোড দিয়ে মিছিল করছিল। পুলিশের মুখপাত্র বলেছেন, করোনাভাইরাসের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করায় ১০ জনের মতো আটক হয়েছেন।

অস্ট্রিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ৬৬ শতাংশ করোনার টিকা নিয়েছেন। যা পশ্চিম ইউরোপের সর্বনিম্ন হারগুলোর মধ্যে একটি। অনেক অস্ট্রিয়ান ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান। তারা অতি-ডানপন্থী ফ্রিডম পার্টি দ্বারা উৎসাহিত। যা দেশটির সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দল।

ফ্রান্স
ফ্রান্স শাসিত ক্যারিবিয়ান দ্বীপ গুয়াদেলুপে রোববার তৃতীয় দিনের মতো করোনা বিধিনিষেধ বিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত হয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, সেখানে দাঙ্গা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ বিদেশি এই এলাকায় বাড়তি পুলিশ পাঠাচ্ছে।

আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, গুয়াদেলুপের বিভিন্ন জায়গায় রাতভর বিভিন্ন দোকান ও বড় বড় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট হয়। দাঙ্গার সময় বিভিন্ন জনের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জিরাল্ড ডারমানিন বলেন, বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গোলাবারুদ ব্যবহার করেছে। তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ফ্রান্স সরকার রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলার স্থান এবং দূর ভ্রমণে কোভিড পাসের বিধি আরোপ করেছে। মূলত এই কোভিড পাসের প্রতিবাদের গুয়াদেলুপে বিক্ষোভের সূচনা ঘটে। বিচ্ছিন্ন ওই দ্বীপে চার লাখ মানুষের বসবাস। সেখানকার মাত্র ৩৩ শতাংশ মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকার আওতায় আনা হয়েছে। অথচ পুরো ফ্রান্স জুড়ে টিকাদানের এই হার ৭৫ শতাংশ।

ক্রোয়েশিয়াস ও ইতালি
ক্রোয়েশিয়ায় সরকারি কর্মীদের জন্য টিকা বাধ্যতামূলক করার প্রতিবাদে রাজধানী জাগরেবে বিক্ষোভ করেছেন হাজারো মানুষ। ইতালিতে কর্মস্থল ও গণপরিবহনে গ্রিন পাস সনদ ব্যবহারের নিয়ম জারি হওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!