রোমানিয়ার ‘প্যালেস অব পার্লামেন্ট’ : যা দেখলাম অনবদ্য স্থাপনায়
‘ভার বা ওজনের কারণে প্রতিদিন একটু একটু করে মাটিতে ডুবছে। স্থপতিদের হিসেবে, বছরে ৬ মিলিমিটার করে বসে যাচ্ছে ভবনটি’—গত ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এমন খবরে আতকে উঠেছিলাম, দেখা কি আর হবে না? ইউরোপের যে কয়েকটি দর্শনীয় স্থাপনা দেখা আমার মনোবাসনার তালিকার আছে এ নির্দশন তো তার অন্যতম। ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা চিন্তায় থাকলেও হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত নয়, গেলেও ৬ মিমি হিসেবে তো অনেক সময়! তারপরও ছঁক কষেছিলাম সময় সুযোগে দ্রুত দেখে ফেলার। গত মাসে সৌভাগ্যটাও ধরা দেয়!
‘প্যালেস অব পার্লামেন্ট’—বলকান দেশ রোমানিয়ার আইনসভা বা সংসদ ভবন, যেটি পেয়েছে বিশ্বের ‘সবচেয়ে ভারী’ এবং ‘ব্যয়বহুল’ ভবনের তকমা। সে সঙ্গে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে অধিকার করে বৃহত্তম প্রশাসনিক ভবনের জন্য (বেসামরিক ব্যবহারের জন্য) প্রথম অবস্থান এবং আয়তনের দিক থেকে বিশ্বব্যাপী তৃতীয় স্থান। রাজধানী বুখারেস্টের পাহাড়ের ওপরে স্থাপিত এ প্রাসাদ ভবনের ওজন ৪ দশমিক ১ মিলিয়ন টন (প্রায় ৪০৯ কোটি ৮৫ লাক্ষ কিলোগ্রাম) বলে ধারণা। ১৯৯৭ সালে উদ্বোধনের সময় বাজার মূল্য ছিল আনুমানিক ৪ বিলিয়ন ইউরো। ২০২০ সালের হিসেবে, প্রতি বছর বিদ্যুৎ খরচই হয় প্রায় ৬০ লাখ ডলার!
দেশ থেকে লম্বা ছুটি কাটিয়ে লিসবনে ফিরে ব্যস্ততায় ডুবে থাকার মাঝেও রোমানিয়ান বন্ধুর দাওয়াতের হাতছানি আর ছাড়তে পারিনি শুধু এ রাজকীয় সংসদ ভবনের লোভে। সঙ্গী ছিলেন পর্তুগালপ্রবাসী সংগঠক ও সাংবাদিক রনি মোহাম্মদ। ভ্রমণ পাগল মানুষটির সঙ্গে ৩ দিনের বুখারেস্টে সফরে আমার একমাত্র দর্শন গন্তব্যই ছিল ‘প্যালেস অব পার্লামেন্ট’, ইতিহাসে নির্মম স্বৈরশাসক রোমানিয়ার সাবেক কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চসেস্কু’র অনবদ্য গাঁথুনি!
রোমানিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ হলেও সেনজেন ভিসার আওতায় নয়। বাংলাদেশিসহ অনেক দেশের পর্যটকদের আলাদা ভিজিট ভিসা লাগে। তবে ইউভুক্ত দেশগুলোর বৈধকার্ডধারী আমাদের মতো প্রবাসীদের অন অ্যারাইভ্যাল ভিসা সুবিধা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু হোটেল বুকিং আর ফিরতি টিকিটের নিশ্চয়তা।
লিসবন থেকে বুখারেস্টের সরাসরি ফ্লাইট সপ্তাহে মাত্র দুটি, তাও আবার বেশি ভাড়া। কাছাকাছি দেশ দিয়ে ট্রানজিটে যাওয়াই সহজ-সাশ্রয়ী। আমরা স্পেনের মাদ্রিদ ট্রানজিট হয়ে বুখারেস্টের গিয়েছিলাম, অবশ্য ফিরেছিলাম সরাসরি ফ্লাইটে।
মাদ্রিদে ট্রানজিটসহ প্রায় ৭ ঘণ্টার আকাশপথ পাড়ি দিয়ে রাত দেড়টায় বুখারেস্টের হেনরি কোয়ান্ডা বিমানবন্দরে নেমে ইমিগ্রেসন অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো। স্বপক্ষে সব কাগজ-প্রমাণ দেওয়ার পরও টুরিস্ট হিসেবে আমাদের বিশ্বাসে নিতে পারছিল না ইমিগ্রেশন কর্তা । প্রায় দেড় ঘণ্টা মানসিক নির্যাতন শেষে আমাদের মুক্তি পেলাম আমরা। এয়ারপোর্টের বাইরে এসে অপেক্ষায় থাকা শাহিন দর্জিকে পেলাম, বিশেষ কাজে বুখারেস্টের অবস্থান করছিল সে। পরদিন তার সঙ্গতে দেখা হলো কাংখিত প্যালেস অব দ্য পার্লামেন্ট।
বুখারেস্টের ডাম্বোভিটা পাহাড়ের ওপর দণ্ডায়মান মোট ৩৯ লাখ ৩০ হাজার বর্গফুট (৩ লাখ ৬৫ হাজার বর্গমিটার) বিস্তৃতির প্যালেস অব পার্লামেন্ট। মূলত রোমানিয়ার আইনসভার দু’টি কক্ষ সেনেট এবং চেম্বার অব ডেপুটির কাজকর্ম এখানে হয়ে থাকে। এ ছাড়া রয়েছে ৩টি জাদুঘর এবং একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। এক সময় সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ এবং সর্বগ্রাসীবাদের উপাসনা করা একটি নির্মাণ হিসেবে অভিপ্রেত ভবনটি, এখন ভেতরে থাকা রোমানিয়ার সাংবিধাদিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে (চেম্বার অব ডেপুটিজ, সিনেট, আইন পরিষদ, সাংবিধানিক আদালত) গণতন্ত্রের প্রতীক হয়ে ওঠেছে। ‘রিপাবলিকস হাউস’, ‘পিপলস হাউস’ বা ‘পিপলস প্যালেস’ নামেও পরিচিত ভবনটি।
আমরা টিকিট কিনে পার্লামেন্ট ভবনের গাইডেড টুরের সঙ্গী হই। দেড় ঘণ্টা ভ্রমণের প্রতি টিকিট ৮০ লিউ। দিনে একটি গাইডেড টুরের ব্যবস্থা, বিকেল ৩টায় শুরু। সময় মতো এক তরুণ ও সুদর্শন গাইডের নেতৃত্বে আমরা ৩ প্রবাসী বাংলাদেশিসহ নানা দেশের ২৫-৩০ জনের পর্যটক দলের ভবন দর্শন শুরু হয়। যতই যাচ্ছি নির্মাণশৈলী, বিশালতা, কারুকাজ এবং পরিকল্পনা দেখে মুগ্ধ হতে হচ্ছে। আমাদের মতো বাকিদেরও বিস্ময়ভর চোখ। চলতে চলতে গাউডের বর্ণনায় ওঠে আসে নির্মাণ থেকে শুরু করে ভবন আদ্যপ্রান্ত ইতিহাস। বর্ণনা এতটা প্রাণবন্ত, যেন সবকিছু আমাদের চোখের সামনেই ভেসে উঠছে। আমার সঙ্গে বুখারেস্ট আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের বুকলেটও ছিল।
গাইডের বর্ণনায় আর কেন্দ্রের তথ্য বাতায়ন অনুসারে, ১৯৭৫ সালে ভূমিকম্পের পরপরই নগরায়নের প্রচারণার ফলস্বরূপ এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম ইল সুংয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে, একটি নতুন রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু করেন, তৎকালীন কমিউনিস্ট রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চসেস্কু। প্রবণতা ছিল, একদিকে রাষ্ট্রের সমস্ত প্রধান সংস্থাগুলোকে এক ভবনে কেন্দ্রীভূত করার। অন্যদিকে, ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে বসবাসের জন্য একটি নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা, যা এমনকি পারমাণবিক আক্রমণ ঠেকাতে পারে।
পাহাড়ের উঁচু অংশ ভবন নির্মাণের জন্য নিরাপদ বলে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেন। ১৯৮০ সালে জমি অধিগ্রহণে বুখারেস্টের প্রায় ৫ শতাংশ (দৈর্ঘ্যে ৪.৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ২ কিলোমিটার) অঞ্চলের সব স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়, যা প্যারিসের কয়েকটি জেলা এবং ভেনিসের মোট ভূপৃষ্ঠের সমতুল্য! ২০টি গির্জা ধ্বংস, ৮টি স্থানান্তর ও ১০ হাজার বাড়ি ভেঙে ফেলা হয় এবং ৫৭ হাজারেরও বেশি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। ধ্বংসের মধ্যে বিশ্বের প্রথম ফরেনসিক মেডিসিন ইনস্টিটিউট ও জাতীয় সামরিক জাদুঘরের মতো স্থাপনাও ছিল।
ভবন নির্মাণ শুরু হয় ১৯৮৪ সালে, শেষ হয় ১৯৯৭ সালে। প্রধান স্থপতি অ্যানকা পেত্রেস্কুর তত্ত্বাবধানে ৭০০ স্থাপত্যশিল্পীর ১৩ বছরের চেষ্টায় গড়ে ওঠে উত্তরাধুনিক আর নিওক্লাসিক্যাল মিশ্রণ শৈলীর প্যালেস অব পার্লামেন্ট। ৩টি শিফটে কাজ করে প্রায় ১ লাখ শ্রমিক। ১২ হাজার সৈন্যও নির্মাণ কাজে যোগ দিয়েছিল। ১৯৮৯ সালে স্বৈরশাসক চসেস্কুর পতনের সময় ভবনটির ৬০ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল। পরে অনেক ধীর গতিতে চলে কাজ।
ইতিহাস বলছে, ১৯৮৯ সালের ২২ ডিসেম্বরে বুখারেস্টে আন্দোলনকারী বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিরোধের মুখে চসেস্কু ও তার স্ত্রী এলিনা হেলিকপ্টারে করে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন। সংক্ষিপ্ত বিচারে ক্ষমতাচ্যুত দম্পতিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২৫ ডিসেম্বর গুলি করে সেই দণ্ড কার্যকর করা হয়। এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে চসেস্কুর ২ দশকের স্বৈরশাসনের।
করিডর দিয়ে ইউনিয়ন হলে যাওয়ার সময় গাইডের বর্ণনায় ওঠে অসে, রোমানিয়ায় উৎপাদিত নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে ভবনটি তৈরি করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে: ১০ লাখ কিউবিক মিটার মার্বেল, ৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন সিমেন্ট, ৭ লাখ মেট্রিক টন ইস্পাত, ২০ লাখ টন বালি, ১ হাজার টন ব্যাসাল্ট, ৯ লাখ কিউবিক মিটার দামি কাঠ, ৩ হাজার ৫০০ টন স্ফটিক (ক্রিস্টাল), ২ লাখ কিউবিক মিটার কাঁচ, ২৮০০টি ঝাড়বাতি, ২ লাখ ২০ হাজার বর্গমিটার কার্পেট, ৩ হাজার ৫০০ বর্গমিটার চামড়া। হলঘরের দরজা রোমানিয়ান প্রেসিডেন্টকে উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন তার বন্ধু কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট মোবুতু সেসে সেকো।
১২ তলার ভবনটির উচ্চতা ২৭৬ ফুট (৮৪ মিটার), লম্বা ৮৮৬ ফুট (২৭০ মিটার), চওড়া ৭৮৮ফুট (২৪৫ মিটার), গভীরতা (মাটির নিচে) ৫৩ দশমিক ৫ ফুট (১৬ মিটার) এবং ফুটপ্রিন্ট এলাকা ৭৩ হাজার ৬১৫ বর্গমিটার। ভবনের মাটির নিচে ৮টি তলা রয়েছে। পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কায় নাকি মাটির গভীরে ভবন প্রশস্ত করেন চসেস্কু। প্রধান স্থপতি অ্যানকা পেত্রেস্কুর এটিকে লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেস এবং ফ্রান্সের ভার্সাই প্রাসাদের সঙ্গে চিহ্নিত করেছিলেন ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্যালেস অব পার্লামেন্টে মোট ১ হাজার ১০০টি ঘর থাকার কথা। সেখানে মাত্র ৪৪০টি অফিস হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এ ছাড়া ৩০টি বল রুম, ৪টি রেস্টুরেন্ট, ৩টি পাঠাগার, একটি বড় কনসার্ট হল রয়েছে। হাজার হাজার স্কয়ার মিটার খালি জাগয়ায় কি হচ্ছে বা হবে তা অজানা, উল্লেখ করেননি গাইড।
তথ্য বাতায়ন থেকে আরও জানা যায়, ১৯৯৩ সালে চেম্বার অব ডেপুটিজের (সংসদের নিম্নকক্ষ) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্যালেস অব দ্য প্যাট্রিয়ার্কেটে অবস্থিত চেম্বারের কার্যকলাপ সংসদের প্রাসাদে (পূর্বে কাসা রিপাবলিক নামে পরিচিত) স্থানান্তরিত হয়। এক বছর পর (১৯৯৪) অন্য সিদ্ধান্ত অনুসারে, একই জায়গায় বুখারেস্ট আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৪ সালে রোমানিয়ান সিনেটের প্রথম চেম্বার প্রতিষ্ঠার ১৪০ বছর উদযাপন এবং দেশে দ্বিকক্ষ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন প্লেনাম রুম আনুষ্ঠানিকভাবে খোলা হয়।
১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রানস মন্টানা সম্মেলন, ২০০৮ সালের ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনসহ অনেক আন্তজার্তিক ইভেন্টের ভেন্যু হয়ে বিশ্ব কূটনীতির ইতিহাস হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রটি। ক্রানস মন্টানা ফেরামে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেস এবং পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে মিলিত হন। এই বৈঠকের ফলে সেই প্রক্রিয়ার সূচনা হয় যা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের দিকে পরিচালিত করে।
সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত কয়েকটি সেমিনার হল, মূল করিডর, এক্সিবিশন হলসহ ভবনের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু অংশ আমরা দেখার সুযোগ পাই। গাইডের মতে, আয়তন বিবেচনায় তা সামান্য। এতেই যে কখন যেন দেড় ঘণ্টা চলে গেল টেরই পাইনি। ভবনের রূপে এতটাই বিহবল ছিলাম, দেবে যাওয়ার বিষয়ে গাইডের কাছে আর প্রশ্ন রাখা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারের কারণে মাটির নিচের পলিতে প্রবল চাপ সৃষ্টি করছে, ফলে পলিস্তর একটু একটু করে নিচে নামছে। সেই কারণেই দিন দিন বসে যাচ্ছে ভবনটি…..।
মো. রাসেল আহম্মেদ : পর্তুগালপ্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ।
div class=”bs-shortcode-alert alert alert-info”>
[প্রিয় পাঠক, আকাশযাত্রা প্রবাস বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকসহ কমিউনিটি ও সংগঠনের নানান খবর, ভ্রমণ, আনন্দ-বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। লেখা ছবিসহ মেইল করুন [email protected]এই ঠিকনায়]