ইস্তানবুলের ‘গ্লাসবন্দী অজুরত ৮ পরী’ কাহিনীর নেপথ্যে!

“একদা ইস্তানবুলে একদল পরী একসাথে নামাজ পড়তে মানুষজনের মাঝে এসেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যর কি নির্মম পরিহাস! সবাই আকাশের দিকে চলে গেলেও তাদের মধ্য থেকে আটজনকে মানুষ আটক করে সারা জীবনের জন্য গ্লাস বন্দী করে রাখলেন।”

অতি সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া তুরস্কের ইস্তানবুলে এমন কাহিনী নিয়ে একটি লাইভ ভিডিও বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছি, অনেকেকে আগ্রহী করে তুলেছে। কেউ বিশ্বাস করছেন আরও কারো প্রশ্ন আসল কতটুকু সত্য এই ঘটনা।

ওসমানী খিলাফতের এক সময়কার রাজধানী ইস্তানবুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হল ফাতিহ এলাকা। ২০১৪ সাল থেকেই আমি এই এলাকায় বসবাস করি, কিন্তু এই ধরনের কোন ঘটনা এর আগে শুনিনি। গত দুইদিন আগে ইফতার করার পর হঠাৎ দেখি ফেসবুকে অনেক লোক নক দিচ্ছেন এবং ভিডিওটি শেয়ার দিয়ে সবাই জানতে চায় ঘটনার বাস্তবতা বা নেপথ্যে কাহিনী।

Travelion – Mobile

ফেসবুক দেখতে থাকলাম। দেখলাম এক বাংলাদেশি আমার বাসা থেকে খুবই কাছের একটা স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে ফেসবুকে লাইভে গিয়েছিলেন এবং সিলেটি ভাষায় ৫ মিনিট ২১ সেকেন্ডের ভিডিও করেছেন যেটি তার টাইমলাইনে আপ করা হয়েছে। উপস্থাপনায় তিনি জানান, একদল পরী থেকে ৮ জনকে আটকিয়ে লোকজন গ্লাস বন্ধী করেছেন, আর বাকিরা সবাই পালিয়ে গেছেন।

তার ওই ভিডিও কয়েক ঘণ্টায় হাজার হাজার ভিউ এন্ড শেয়ার হয়ে যায়। অনেকে এটা নিয়া হাসি-তামাশা করার জন্য শেয়ার দিচ্ছেন। আবার অনেকে না জেনেই সরল মনে বিশ্বাস করতেছেন।

মূলত এ ঘটনার সঙ্গে পরীর কোন যোগ নেই আছে মানুষের তবে যাদের দেখানো হচ্ছে তারা আবার বাস্তব নন, পুরো ঘটনা তুরস্কের ইস্তানবুলের ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় জায়গা “১৫ জুলাই সারাছহানে স্মৃতিসৌধ” ঘিরে। এবার জেনে নিন মূল রহস্য…।

হাইপাররিয়ালিস্ট (বাস্তববাদী) কৌশল দ্বারা নির্মিত "১৫ জুলাই সারাছহানে স্মৃতিসৌধ"
হাইপাররিয়ালিস্ট (বাস্তববাদী) কৌশল দ্বারা নির্মিত “১৫ জুলাই সারাছহানে স্মৃতিসৌধ”

২০১৬ সালের ১৫ জুলাই এরদোয়ান সরকারের বিরুদ্ধে ফেতুল্লাহ গুলেন সমর্থিত বিশ্বাসঘাতক একটি সেনাদল ক্যু করা শুরু করে এবং তারা রাতের মধ্যে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি জায়গা দখলের চেষ্টা করে। তারা বিভিন্ন সরকারি ভবন দখলের পাশাপাশি এক পর্যায়ে আসেন ইস্তানবুল নগর ভবন দখলের জন্য।

Diamond-Cement-mobile

রাতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ৫ মিনিটের একটা ভিডিও বার্তা চারদিকে চড়িয়ে পড়লে সাথে সাথে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় চলে আসে। তারা বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে রক্ষার্থে বিভিন্ন অফিস আদালত ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে অবস্থান নেয়। এর অংশ হিসেবে সাধারণ মানুষের একটি দল ইস্তানবুল সিটি কর্পোরেশন ভবনের ভিতরে চলে আসে। যখন শত্রু পক্ষ গুলি শুরু করে তখন সাধারণ মানুষদের একটি দল বুলেটের আওয়াজ শুনে তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য নগর ভবনের সামনে অবস্থিত পুল থেকে অজু করে শত্রু মোকাবেলায় সামনে এগিয়ে যায় এবং অনেকে সেদিন ওখানে মৃত্যুবরণ করেন।

সিটি কর্পোরেশন থেকে পরবর্তীতে তাদের স্মরণার্থে হাইপাররিয়ালিস্ট কৌশল দিয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন, যেখানে লন্ডন বা ব্যাংককের বিশ্ব খ্যাত তুশোর মোমের যাদুঘরের মতো আবৃহ সৃষ্ঠি করা হয়েছে।

যে হাইপাররিয়ালস্টিক তাদেরকে অমর করে দেয়। স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধনকালে ইস্তানবুলের মেয়র মেভলুত উইসাল বলেছিলেন,”এই স্মৃতিস্তম্ভটি একটি বিশেষ কাজ যা ১৫ শে জুলাইকে আগামী প্রজন্মের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার মাত্রা এবং আমাদের জাতির বীরত্ব প্রদর্শনের চিত্র জাতির সামনে তুলে ধরতে সাহায্য করবে।”

মূলত সিটি কর্পোরেশন থেকে ১৫ জুলাইতে বিশ্বাসঘাতকদের অভ্যুত্থানের প্রয়াসকে ভুলে ও ভুলতে না দেওয়ার জন্য “১৫ জুলাই সারাছহানে স্মৃতিসৌধ” তৈরি করা হয়েছিল ।

হাইপাররিয়ালিস্ট (বাস্তববাদী) কৌশল দ্বারা নির্মিত “১৫ জুলাই সারাছহানে স্মৃতিসৌধ” নাগরিকদের কাছ থেকে প্রচুর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং তার প্রশংসাও কুড়িয়েছিল। যেটি দেখার জন্য প্রতিদিন দর্শনারথীরা ভিড় জমায়।

এখানে বিভিন্ন বয়সের এবং শ্রেণি পেশার লোকদের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু হাইপাররিয়ালিস্ট (বাস্তববাদী) কৌশল দিয়ে তৈরি করার কারণে এটি কে যে কেউ প্রথম দেখার পর আসলেই মানুষ অজুরত অবস্থায় আছেন মনে করেন। আমরা প্রায়ই ওই পথ দিয়ে হাটার সময় দর্শকদের কে এটি উপভোগ করতে দেখি। এবং অনেকে কাছ গিয়ে সেটি ছুঁয়ে দেখেন।

বিষয়টি আগের থেকে কারো জানা না থাকলে গ্লাসের খুব কাছে না গেলে এটি অরিজিনাল নয় সেটি বুঝতে পারবেন না। বিশেষত রাতের বেলায় এটি খুবই আকর্ষণীয় দেখায়। নতুন কেউ রাতের বেলায় এই পথ দিয়া হেঁটে যেতে এটি দেখলে মাথায় অনেক চিন্তা আসতেই পারে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ স্টুডেন্টস’ অ্যাসোসিয়েশান তুরস্ক।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!