অবতারের প্যান্ডোরা পাহাড়
এ যাবৎকালের অন্যতম ব্যবসা সফল ছবি অবতার (এ্যাভেটার) এর কথা কমবেশি সকলেরই জানা। ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া এ চলচিত্র আয় করেছিল ২.৭৮৯৭ বিলিয়ন ডলার।
এভেঞ্জার্স এন্ডগেম চলচিত্রের আগ পর্যন্ত বক্স অফিসে এটিই ছিল বিশ্বের সর্বাধিক আয়ের চলচিত্র। যারা এই ছবি দেখেছেন তাদের সকলেরই নজর কেড়েছিল এর বিভিন্ন দৃশ্যে স্তম্ভের মতো লম্বা লম্বা রহস্যেঘেরা পর্বতমালা। চলচিত্রে এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছিল প্যান্ডোরার পাহাড়।
বিচিত্র এই পর্বতঘেরা অঞ্চলটি দেখে প্রথমে ভিন গ্রহের কথাই মনে আসবে। বিখ্যাত পরিচালক জেমস ক্যামেরনও তার অবতার ছবিতে এসব অলৌকিক আদলের বিচিত্র পাহাড়ের আদলে ভিনগ্রহের একটি পরিবেশই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
বাস্তবে এসব পাহাড় কিন্তু ভিনগ্রহের নয়। পৃথিবীতেই এদের অস্তিত্ব আছে। এশিয়া মহাদেশের প্রাণকেন্দ্র চীনের হুনান প্রদেশের ঝাংজিয়াজিতে কোটি কোটি বছরের বিবর্তনে জেগে উঠেছে এসব পর্বত।
রহস্য আর বিস্ময় নিয়ে পৃথিবীর নানান দেশের লাখ লাখ পর্যটক এসব পাহাড় দেখতে ছুটে আসেন প্রতি বছর। জেমস ক্যামেরনের চলচিত্র অবতার দেখে যারা ভীনগ্রহের প্যান্ডোরা নিয়ে স্বপ্নে হারিয়েছেন তাদের তাই আফসোসের কিছু নেই।
চীনের ঝাংজিয়াজির উলিংইউয়ান সিনিক এলাকাজুড়ে এমন প্রায় ৩,০০০ খাড়া পাহাড় আপনার অপেক্ষায় রয়েছে, যাদের প্রতিটি অন্তত একশ মিটার লম্বা এবং ঘন সবুজ পাতায় আবৃত। কোটি বছর ধরে এই পাহাড়গুলি কোয়ার্টজ স্যান্ডস্টোন দিয়ে তৈরি হয়েছে।
স্তম্ভ আকৃতির এই পাহাড়গুলির সর্বোচ্চ স্তম্ভটির উচ্চতা ১,২১২ মিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ওই স্তম্ভটির উচ্চতা ৪১৪০ মিটার। এগুলোর বিচিত্র গঠনের জন্য এগুলিকে পাহাড়ের পরিবর্তে স্তম্ভ হিসাবে উল্লেখ করেন ভূতত্ত্ববিদরা।
এদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা স্তম্ভটি হল সাউদার্ন স্কাই কলাম, যেটি ৩,৪৫৫ ফুট জুড়ে শূণ্যে প্রসারিত এবং দৈর্ঘ্যে ৭৮ টি স্কুল বাসের সমান। বছরের পর বছর ধরে পাথরের উপর পলি জমে এখানে পাইন গাছ জন্মানোর উপযু্ক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পাহাড়ের গায়ে পাইন গাছের জঙ্গল দেখা যায় এই অঞ্চলে।
হলিউড চলচিত্র অবতারের বিরাট সাফল্যের পর এই স্থানের নামকরণ করা হয় অবতার পাহাড়। এটিকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে চীন সরকার এই জাতীয় উদ্যানটিকে ঘিরে নানারকম প্রচারণা শুরু করে।
তাদের কিছু সফল প্রচেষ্টার স্লোগান হল, “পান্ডোড়া তো দূরের কথা তবে ঝাংজিয়াজি কাছেই আছে” কিংবা “পান্ডোরার আসল বিশ্ব আবিষ্কার করুন”। সন্দেহ নেই অবতার চলচিত্রের তুমুল জনপ্রিয়তার পর ঝাংজিয়াজির পরিচিতি বেড়েছে।
ঝাংজিয়াজি জাতীয় উদ্যান ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় ২৪৮ বর্গকিলোমিটার (১০২ বর্গমাইল) এলাকাজুড়ে। এটিকে এখন চীনের একটি প্রধান পর্যটন আকর্ষণ ধরা হয়। শীতকালে এই অঞ্চলটি পুরু বরফের চাদরে ঢেকে যায়। পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য এই অঞ্চলে ২০৮৪ মিটার দীর্ঘ কেবল কার পরিষেবা চালু রয়েছে।
কেবল অবতার পর্বতই নয় ঝাংজিয়াজি জাতীয় উদ্যানে গেলে দেখা মিলবে পৃথিবীর দীর্ঘতম এবং সর্বোচ্চ সেই রোমাঞ্চকর কাঁচের সেতু। ঝুলন্ত এ সেতুর নাম ঝাংজিয়াজি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ান কাঁচসেতু। ঝুলন্ত এ সেতুটি এ জাতীয় উদ্যানের দু’টি পাহাড়কে যুক্ত করেছে। এটি তৈরি করা হয়েছে প্রায় ৯৮০ ফুট খাড়া খাদের ওপর যা প্রায় দেড় হাজার ফুট দীর্ঘ। প্রায় ২০ ফুট প্রস্থের এ সেতুতে একসাথে ৮০০ থেকে ৮৫০ জন মানুষ ঘুরে বেড়াতে পারে।
ঝাংজিয়াজি জাতীয় উদ্যানের আরেক আকর্ষণ হল বিখ্যাত তিয়ানমেন পর্বত। এ পর্বত বেয়ে উপরে উঠতেই চোখে পড়বে স্বর্গের সিড়িখ্যাত ‘হেভেনস গেট’। এসব প্রধান আকর্ষণ ছাড়াও ঝাংজিয়াজি ন্যাশনাল পার্কের বুনো সৌন্দর্য্য আর পাহাড়ী লেকের সচ্ছ জল আপনার ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে দিবে ভিন্নমাত্রা।
টিকেট মূল্য:
উইলিংইউয়ান পর্যটন কেন্দ্রের ঝাংজিয়াজি পর্বত পরিদর্শন করতে আপনাকে টিকেট কাটতে হবে। টিকেট মূল্য পর্যটন মৌসুমে থাকে ২৪৫ ইউয়ান (বাংলাদেশের ১,৭০০ টাকা) আর অফ সিজনে এটি হয় ১৪০ ইউয়ান।
কখন যাবেন:
সাধারণত, এপ্রিল থেকে অক্টোবর ঝাংজিয়াজি পর্বত দেখার সেরা সময়। এপ্রিল থেকে জুন হ’ল বর্ষাকাল। এসময় কুয়াশারঢাকা মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশ পুরো দৃশ্য এনে দেবে মনোমুগ্ধকর ছোয়া। এই সময় মধ্যে টিকিটের দামও কম থাকে, আবহাওয়া থাকে উপযোগী।
কীভাবে যাবেন
চীনের অন্যতম প্রধান শহর বেইজিং, সাংহাই, চেংডু এবং শি’য়ান থেকে ঝাংজিয়াজি যাওয়ার জন্য সরাসরি ট্রেন এবং ফ্লাইট রয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নতি সত্ত্বেও, ঝাংজিয়াজি এখনও পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত একটি ছোট শহর। এখানে একটি ছোট বিমানবন্দর আছে।
সড়ক পথে এটি জাতীয় মহাসড়কের সাথে যুক্ত হলেও সরাসরি কোনও দ্রুতগতির রেল যোগাযোগ নেই। বাসে করে চাংশা থেকে আন্তঃনগর বাসগুলিতে ৫ঘন্টা সময় লাগে ঝাংজিয়াজি পৌছুতে। সন্ধ্যে ৭ টা পর্যন্ত প্রতি ঘন্টায় এসব বাস ছেড়ে যায় যার টিকেট মূল্য প্রায় ১২০ ইউয়ান।
এখানকার ঝাংজিয়াজি হেহুয়া বিমানবন্দর থেকে নেমে একটি ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে যান মূল বাস স্টেশনে। সেখান থেকে ছোট বাস আপনাকে নিয়ে যাবে মূল পার্কের প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি ওলিংয়ুয়ান শহরে। আপনি যদি সন্ধ্যার দিকে দেরিতে পৌঁছান তবে বাসগুলি আর সেখানে যায় না, তাই একমাত্র বিকল্প হল ট্যাক্সি।
বাসে ১০ (বাংলাদেশের ১২১ টাকা) দিয়ে আর শহর থেকে ট্যাক্সিতে সর্বোচ্চ ২০০ ইউয়ান (বাংলাদেশের ২,৪০০ টাকা) দিয়ে আপনি পৌছে যেতে পারেন গন্তব্যে। এক্ষেত্রে ট্যাক্সিতে গেলে চালককে মিটার ব্যবহার করতে অনুরোধ করবেন এবং ভাষা জটিলতা কাটাতে মোবাইলের অনুবাদ অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করুন।
বাংলাদেশ থেকে কীভাবে যাবেন
বাংলাদেশ থেকে বেইজিং, সাংহাই, চেংডু বা শিয়ানে সরাসরি ফ্লাইট নেই। তবে কানেকটিং ফ্লাইটে চায়না ইস্টার্ণে করে কুনমিং হয়ে, বাংলাদেশের ইউএস বাংলা বা এয়ারলাইন্সে চায়না সাউদার্নে গুয়াংজু হয়ে, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে সিঙ্গাপুর হয়ে, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সে কুয়ালালামপুর হয়ে কিংবা শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সে কলম্বো হয়ে বেইজিং যাওয়া যায়, সেখান থেকে ঝাংজিয়াজি। এক্ষেত্রে এক বা দেড় মাস আগে টিকেট কাটলে যাওয়ার খরচ পরবে আনুমানিক ২৫,০০০ টাকা থেকে ৪৫.০০০ টাকা।
সাংহাই, বেইজিং রুট খরচ বেশি পড়বে। সবচেয় সহজ ও কম দূরত্বের হল গুয়াংজু থেকে। তবে সবচেয়ে কম খরচে যেতে পারবেন ঢাকা থেকে চেংডু গেলে। ইনডিগোর একটি ফ্লাইট ঢাকা থেকে দিল্লি হয়ে চেংডু যায়, এতে খরচ পড়বে আনুমানিক ২০ থেকে ২৫,০০০ টাকা।
কোথায় থাকবেন
ঝাংজিয়াজি জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণে গেলে থাকার সবচেয়ে ভাল জায়গাটি হল মূল পার্কের প্রবেশদ্বারের পাশের উলিংইউয়ান শহর। বিমানবন্দর থেকে শহরটি প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
পুরো উলিংইউয়ান শহরেই বেশ কয়েকটি কম দামে রাত কাটানোর হোটেলও পেয়ে যাবেন। যাদের ভাড়া পরবে ২৫ ইউয়ান থেকে ২০০ ইউয়ান পর্যন্ত। এই শহরের গাওয়ুন রোডের ঝাংজিয়াজি পুলম্যান হোটেল আসলে ঝাংজিজিয়ার কয়েকটি ৫ তারকা হোটেলের মধ্যে একটি। অনেক বিদেশীই এখানে রাত কাটাতে পছন্দ করেন। এই হোটেলের অবস্থান উলিংইউয়ান প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলির কাছাকাছি।
এছাড়া ঝাংজিয়াজি জাতীয় উদ্যান ভ্রমণে আরো বিস্তারিত জানতে ঘুরে আসতে পারেন ওয়েবসাইটে ।