লিসবনের মারকেস দি পোম্বাল : ইতিহাসের নীরব সাক্ষী

চব্বিশ বছর পর্তুগালে আছি, রাজধানী লিসবনের প্রাণ কেন্দ্রে। সে সুবাদে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পঁচিশটি দেশের অনেকগুলোই ভ্রমন হয়ে গেছে। সেখানকার দর্শনীয় স্থানের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে মনকে আপ্লুত হয়েছে, জেনেছি ইতিহাস-ঐতিহ্যে। কিন্তু ঘরের পাশেই ঐতিহাসিক স্থানগুলো ভাল করে দেখা জানাটা কখনও হয়ে ওঠেনি। মনে পড়ে যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত পঙক্তিমালা “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশিরবিন্দু”। এমন ভাবনায় এবার ঠিক করলাম লিসবনে ঐতিহাসিকতার সানিধ্যে কিছুটা সময় কাটাবো, ভাল করে জানবো। সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের গাড়িতে নয়, ইয়োলো টুরিস্টবাসে সিটি ট্যুর দিবো। মূল গন্তব্য স্তির করলাম মারকেস দি পোম্বাল।

সকালে সময়মত প্রাসা দি ফিগেইরাতে পৌঁছালাম। যেখান থেকে ইয়োলোবাস যাত্রা শুরু করবে। প্রাসা দি ফিগেইরা বাংলা অর্থ ফিগেইরা চত্বর। চত্বরের চারপাশে সমান তালের উঁচু কমার্শিয়াল বিল্ডিং, যার গ্রাউন্ডফ্লোরে রয়েছে টুরিস্ট গিফটশপ। আশ্চর্যের ও আনন্দের বিষয় দোকানগুলোর বেশিরভাগেরই মালিকা বাঙালি। মূলত প্রায় বিশ বছর ধরে পর্তুগালে টুরিস্ট গিফটশপের ব্যবসা এক চেটিয়া বাংলাদেশিদেরই দখলে।

ঠিক সকাল নয়টায় যাত্রা শুরু হল। ইয়োলো বাসের দোতলায় গিয়ে বসলাম। জুন মাস, প্রচণ্ড গরম না হলেও সেদিন মোটামুটি গরম ছিল। আমার আশেপাশে সিটের সবাই বিদেশি পর্যটকরা। যারা তাপমাত্রার কারণে হালকা পোশাক পরেছেন। একমাত্র আমিই সেখানে আপাদমস্তক ঢেকে বসে আছি। মনে হতে লাগলো দর্শনীয় স্থান অপেক্ষা আমিই তাঁদের কাছে দর্শনীয় হয়ে উঠেছি।

Travelion – Mobile

বাস চলছে শহরের প্রাণকেন্দ্র রোসিও চত্বরের ডোনা মারিয়া সেগুন্দার পাশ দিয়ে। ডোনা মারিয়া সেগুন্দা ছিলেন পর্তুগালের দ্বিতীয় রাণী। তাঁর নামে ১৮৩৬ সালে জাতীয় থিয়েটারের কাজ শুরু হয়ে ১৮৪৬ সালে শেষ হয়। এটিই পর্তুগালের লিসবনে জাতীয় থিয়েটার। এখানে প্রতিদিন শত শত পর্যটক আসেন দেখার জন্য। বাসের সমস্ত যাত্রীদের নামিয়ে ডোনা মারিয়া সেগুন্দা জাতীয় থিয়েটার সম্পর্কে বর্ণনা করলেন টুরিস্ট গাইড। তথ্য ব্যাখ্যা শেষে গাইড আমাদের অন্দর মহলে প্রবেশ করে সব দেখালেন।

রেস্টাউরাডোরেসে এলাকায় আসতেই গতি কমিয়ে চত্বর ঘেঁষে দক্ষিণ প্রান্তে বাস থামল। ১৬৪০ সালের ১লা ডিসেম্বর স্প্যানিস শাসন থেকে মুক্তির স্মরণে রেস্টাউরাডোরেস মনুমেন্টটি স্থাপিত হয় ১৮৮৬ সালে। চত্বরের তলায় পর্তুগালের বিশ্ব খ্যাত আড়ম্বরপূর্ণ পাথর দিয়ে কারুকাজ করা। চত্বরের নাক বরাবর যে রাস্তা দিয়ে বাস চলছে তার নাম আভিনিদা দি লিভারদাদ। দুই ধারে সারি সারি গাছের ছায়ায় ঢেকে আছে পথ। ছায়াবীথি তলে বাস ঢুকতেই অন্যরকম একটা ভালোলাগা শুরু হল। মন সতেজ হয়ে উঠলো নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি অনেকটাই কেটে গেলো। প্রসিদ্ধ এই রাস্তার দুইপাশে রয়েছে পথচলাচলের রাস্তা, বিনোদন মূলক পার্ক, কিওস্ক নামক বেশ কয়েকটি রেস্তরা এবং প্যারালাল আরও চারটি মোটরযানের রাস্তা। খুবই কম সময়ের জন্য এখানে আমাদের যাত্রা বিরতি ছিল।

লিসবনে শহরে লেখক ফৌজিয়া খাতুন রানা
লিসবনে শহরে লেখক ফৌজিয়া খাতুন রানা

অবশেষে আমরা আমাদের কাংখিত গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থানের মধ্যবিন্দু বা মধ্যমনি যে স্থান সেই স্থানটির নাম মারকেস দি পোম্বাল। মারকেস দি পোম্বাল ১৯৩৪ সালের ১৩ মে উদ্বোধন করা হয়েছিল। স্মৃতিসৌধটি চল্লিশ মিটার উঁচু পাথরের প্লিনথ নিয়ে গঠিত। যার উপরে রয়েছে মারকেস পোম্বালের মূল চার সহযোগীদের পদক। শীর্ষে রয়েছে পূর্ণ দৈর্ঘ্য সেবাস্তিআও জোজে দি কারভাইলো ই মেলোর ব্রোঞ্জের মূর্তি। সিংহর পাশে হাত স্থির করে দাঁড়িয়ে থাকা মারকেস পোম্বালের মূর্তিটি শক্তি, দৃঢ়তা এবং রাজকীয়তার প্রতীক।

মারকেস পোম্বাল মূলত একটা উপাধি। সেবাস্তিআও জোজে দি কারভাইলো ই মেলোকে এই উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তিনি ছিলেন আভিজাত্য পর্তুগিজ কূটনীতিক এবং রাজনিতিবিদ, যাঁর জন্ম ১৬৯৯ সালের ১৩ মে এবং মৃত্যু ১৭৮২ সালের ৮ মে । তিনি আজও পর্তুগিজ ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ও ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব। ১৭৫০ থেকে ১৭৭৭ সালের প্রথম রাজা দি জোজের রাজত্বকালে তিনি ছিলেন রাজ্যের সচিব। তাঁর প্রশাসনামলে শিক্ষা, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সংস্কার ইতিহাস খ্যাত হয়ে আছে। বিশেষ করে শিক্ষাসংস্কার। তৎকালীন সময়ে পর্তুগালের শিক্ষা ব্যবস্থায় খৃস্টান ধর্মীয় যাজকদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল।

১৭৫৯ সালে পম্বালিনা সংস্কারের আওতায় এনে তাঁদেরকে পর্তুগিজ অঞ্চল থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পাশাপাশি তাঁর প্রশাসন দুটি বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল। অন্যতম বিপর্যয় ছিল ১৭৫৫ সালের ১লা নভেম্বর লিসবনে ভয়াবহ ভূমিকম্প, সুনামি এবং ভয়াবহ আগুন। এর কবলে পড়ে লিসবন শহর বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে মারকেস পোম্বাল দৃঢ় ভূমিকা পালন করে আংশিকভাবে শহরের পুনঃনির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে লিসবন শহরতলিকে ভূমিকম্প প্রতিরোধের উপযোগী করার জন্য একদল স্থপতি ও প্রকৌশলী দ্বারা নতুনভাবে পরীক্ষা মূলক নকশা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তদনুযায়ী কাঠের কাঠামো ব্যবহার করে সকল ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল।

শহরতলির সেই বিল্ডিংগুলো আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। মারকেস দি পোম্বালের স্বাক্ষরের অধীনে বানানো লিসবনের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র বাইশা পোম্বালিনা দি লিসবোয়ার ভবন ও স্কোয়ারগুলো এখনও আগের মতোই সমান ভূমিকা বহন করছে। মারকেস দি পোম্বাল শহরের ঐতিহাসিক সংস্কারের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ পর্তুগিজ আভিজাত্যদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। বিশেষ করে পাদ্রিদের প্রতিনিধিরা তাঁর সংস্কার পছন্দ করতেন না। একচেটিয়া ধর্মীয় ক্ষমতার অবসানের ফলে পাদ্রিদের সকল সুযোগ সুবিধা হ্রাস পেয়েছিল। তাঁকে অপছন্দের পিছনে এটি ছিল একটি অন্যতম কারন।

১৭৭৭ সালে রাজা জোসেফ মারা গেলে প্রথম রাণী দি মারিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি মারকেস পোম্বালকে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করে সরকারের পদ থেকে সরিয়ে দেন। রানী দি মারিয়া একটি সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে বলেছিলেন, বৃদ্ধ ও অসুস্থ থাকার কারণে তাঁর অপরাধকে ক্ষমা করা হয়েছে । নতুবা তাঁকে দেশ ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হতো। যদিও তাঁকে দেশ ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়নি তথাপি নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছিল তিনি যেন আর কখনই লিসবন শহরে প্রবেশ করতে না পারেন। বাধ্য হয়ে মারকেস পোম্বাল লিসবন ছেড়ে চলে যান তাঁর জন্মস্থান লেইরিয়া শহরের পোম্বাল গ্রামে। শেষ বয়সে মারকেস পোম্বাল গ্রামের একটি সাধারণ অস্বাস্থ্যকর বাড়িতে মারা যান।

ইতিহাসের শেষ অধ্যায় শুনে মনটা বিষাদে ভরে উঠলো। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিলাম এই ভেবে, তৎকালীন স্বল্প সময় তিনি অবিচারের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হলেও মহাকাল তাঁর কর্মের ফল দিতে কার্পণ্য করেনি। ইতিহাস তাঁকে করেছে অমর। লিসবন শহর বর্তমানে তাঁর বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ।

সিটি ট্যুরের যাত্রা শেষে ইয়োলো বাস ছুটছে সাত টিলার শহর লিসবনের আকর্ষণীয় কাস্তিলো নামক রাস্তা দিয়ে। যে রাস্তার দুইপাশে সারি সারি গাছে ফুটে আছে পাতাবিহীন বেগুনি দ্যুতি ছড়ানো মুগ্ধ করা জ্যাকারান্ডার ফুল। ছাদবিহীন বাস থেকে মনে হচ্ছে মাথার উপরে জ্যাকারান্ডার ফুলের চাঁদোয়া দেয়া। পিচঢালা রাস্তায় ঝরে পরা ফুলগুলোর রূপক রূপকে মনে হচ্ছে বেগুনি কার্পেট বিছানো। মুগ্ধ হল হৃদয় সার্থক হল যাত্রা।

ফৌজিয়া খাতুন রানা: পর্তুগালপ্রবাসী লেখক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!