মেক্সিকোতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন

মেক্সিকোতে প্রথমবারের মত দেশটির সংসদের (সিনেট) আদিবাসী বিষয়ক কমিটি এবং ইবেরো-আমেরিকানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের সাথে ‘মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন করেছে বাংলাদেশ দূতাবাস।

২১ শে ফেব্রুয়ারি (সোমবার) এ উপলক্ষে আয়োজিত ওয়েবিনারে মেক্সিকোর সিনেটর, ভাষাবিদ, কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত অংশ নেন। ইবেরো আমেরিকানা ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক ব্যাচেলর বিষয়ক প্রশাসনের সমন্বয়ক ডক্টর অ্যারিবেল কন্ট্রিয়াস পরিচালনায় অনুষ্ঠানে বক্তারা,বাংলাদেশের ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং জাতিগত ভাষা সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

ওয়েবিনারে আদিবাসী বিষয়ক কমিটির সভাপতি সিনেটর সোচিতল গালভেজ বলেন, ২৫ মিলিয়ন আদিবাসী মেক্সিকানদের মধ্যে মাত্র ৬.৫% তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে এবং ৬৮ টি আদিবাসী ভাষার মধ্যে কমপক্ষে ছয়টি ভাষা বর্তমানে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।

Travelion – Mobile

তার মতে, এই বছরের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর প্রতিপাদ্যটি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে থাকা এই ভাষাগুলিকে রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ২০২২ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত আদিবাসী ভাষার আন্তর্জাতিক দশকের সূচনার কথা উল্লেখ করে তিনি মেক্সিকোর বিপন্ন আদিবাসী ভাষাগুলিকে সংরক্ষণে কমিশনের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন।

প্রতি দুই সপ্তাহে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসহ একটি ভাষার অপমৃত্যু ঘটে- ইউনেস্কোর এই ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করে, মেক্সিকো সিনেটের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সিনেটর ওলগা মারিয়া সানচেজ কর্ডেরো ভাষা সংরক্ষণে তাদের দায়িত্বের কথা তুলে ধরেন।

রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মাতৃভাষা সংরক্ষণে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, এই ক্ষুদ্র সম্প্রদায়গুলোর জন্য টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে বাংলাদেশ সরকার তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ করে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে।

মেক্সিকোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া প্যাসিফিক বিভাগের মহাপরিচালক রাষ্ট্রদূত ক্লডিয়া ফ্রাঙ্কো ইহুয়েলোস দূতাবাসের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’এর এমন আয়োজনের মধ্য দিয়ে উভয় দেশের সম্পর্কের নতুন একটি ধারার সৃষ্টি হবে।

তিনি জানান, তার সরকার স্প্যানিশ ভাষার পাশাপাশি মেক্সিকোর ৬৮টি আদিবাসী ভাষার সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও প্রচারের কাজ করে চলেছে। প্রত্যাশা করেন, এই বছরের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ -এর প্রতিপাদ্যটি মানুষকে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় সম্পর্কে আরো সচেতন করবে তুলবে।

আদিবাসী ভাষা সংক্রান্ত জাতীয় ইনস্টিটিউট (INALI) এর ভাষা নীতি বিষয়ক পরিচালক আলমাদিনা কারদেনাস সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে মেক্সিকোর আদিবাসী ভাষাগুলিকে সরকারী ভাষা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে ইনস্টিটিউটের প্রচেষ্টার পাশপাশি এর চ্যালেঞ্জগুলি তুলে ধরেন। তিনি মেক্সিকোর আদিবাসীদের ভাষাকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ভাষার অবকাঠামো ও প্রযুক্তি, গবেষণা এবং ত্রিভাষিক শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন।

মেক্সিকোতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলামসহ কর্মকর্তারা সমবেত কণ্ঠে একুশের গান পরিবেশন করেন।
মেক্সিকোতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলামসহ কর্মকর্তারা সমবেত কণ্ঠে একুশের গান পরিবেশন করেন।

ওয়েবিনারে নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত সারা মেইম্যান্ড তার দেশে মাওরি ভাষার অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এবং দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত ডেনিস থোকোসানি লোমো তার দেশে আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর ভূমির মালিকানার প্রভাবতুলে ধরেন। উভয় রাষ্ট্রদূতই তাদের দেশের সমৃদ্ধ ভাষাগত বৈচিত্র্যের প্রেক্ষাপটে ভাষার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষনে জোর দেন।

ওয়েবিনারের শুরুতে ভাষা শহীদদের সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ ছাড়া দূতাবাসের কাউন্সেলর শাহানাজ রানু ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের বাণী পড়ে শোনান এবং মেক্সিকান সংগীত শিল্পী দিয়েগো ভ্যালেনজুয়েলা স্প্যানিশ ভাষায় ২১শে ফেব্রুয়ারির থিম গানটি পরিবেশন করেন ।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি এবং ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ এর গৌরবোজ্জ্বল স্বীকৃতির উপর একটি তথ্যচিত্র এবং মেক্সিকোর আদিবাসী সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যেরকেওপর ৭টি তথ্যচিত্র ওয়েবিনারে প্রদর্শিত হয়।

মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’এর ভাষা দিবসের ওয়েবিনার মেক্সিকো সিনেটের ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলে সরাসরি প্রদর্শিত হয়, যা স্থানীয় জনগণের বেশ মনোযোগ আকর্ষন করে। অনুষ্ঠানটি মেক্সিকোর বহুভাষিক শ্রোতাদের মধ্যে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের চেতনা ছড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করছে দূতাবাস।

এর আগে সকালে, রাজধানী মেক্সিকো সিটিতে দূতাবাস প্রাঙ্গণে জাতীয় সংগীতের সাথে পতাকা অর্ধনমিতকরনের মধ্য দিয়ে দিনের কার্যক্রম শুরু করেন রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম। এ সময় ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন এবং দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী,পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ করা হয়।

আলোচনা সভায় রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম তার বক্তব্যে মাতৃভাষা ‘বাংলা’র মর্যাদা রক্ষায় আত্ম-উৎসর্গকারী সকল ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে- ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে যার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

অনুষ্ঠানে দূতাবাসের কর্মকর্তারা সমবেত কণ্ঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি পরিবেশনা ও ‘একুশ আমার’ গানটি পরিবেশন করেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!