জার্মানির মিউনিকে দেখে এলাম লিটল বাংলাদেশ

তিন যুগের বেশি সময় ধরে বিদেশে রয়েছি। জীবনে বহু কিছু দেখেছি, শুনেছি, করেছি, করিয়েছি। মিউনিকে দেখলাম এক অদ্ভূত ব্যাপার যা সত্যি ভাবনার বিষয়। মানবজাতির অনুকরণ, অনুসরণের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় অনুশীলন পদ্ধতি, কেউ করে ধ্যানে, কেউ করে জ্ঞানে, কেউ করে নেশায়, কেউ করে পেশায়, কেউ করে শুনে, কেউ করে দেখে।

নেশা বা পেশা এই সব কি জোর করে হয়? না কি অনুকরণ বা অনুসরণের মধ্য দিয়ে হয়? দেখলাম এক ভিন্ন ধরনের নেশা। না, মদের ওপর বা পান সিগারেটের ওপর নেশা নয়; এটা মূলত পড়াশুনোর ওপর নেশা। বাবা বাংলাদেশি, বাবার চাকরি নিউক্লিয়ার মেডিসিনে।

মা একাউন্টেন্ট, বেশ স্বচ্ছল পরিবার নিয়ে মিউনিকে চলছে তাঁদের জীবন। দুই মেয়ে বয়স ১১ ও ৮ বছর। জন্ম জার্মানিতে এবং গড়ে উঠছে জার্মানের নতুন প্রজন্ম হিসাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

Travelion – Mobile

মাক্সিম রহমান বয়স ১১। ক্লাস সিক্সে মেধা অনুযায়ী ক্লাসের প্রথম স্থানটি সে ধরে রেখেছে মিউনিকের সেরা ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে।

সঙ্গে অবাক করেছে জার্মান জাতিকে যে বিদেশী বাবা-মা এবং সেটা বাংলাদেশি যা ছিলো এদের কাছে গরিব দেশের মানুষ হিসাবে পরিচিত। কিন্তু এখন সেটা তাদের মাথাতে নেই। এখন তাদের ভাবনা “কী করে সম্ভব এই বাংলাদেশি মেয়ে আজ সেরাদের মধ্যে সেরা, তাও এই জার্মানিতে”!

মাক্সিম, সে তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু খুঁজে পেয়েছে তার বইয়ের মধ্যে। তাই এত বড় অ্যাসিভমেন্ট তার জীবনের শুরুতে।

জার্মানির স্কুলের গ্রেড পয়েন্ট সিস্টেম কিছুটা ভিন্ন ধরনের সুইডেনের তুলনায়। এখানে গ্রেড পয়েন্ট ১-৬। ১ মানে বেস্ট, ৪ মানে পাশ, ৫-৬ মানে ফেল। মজার ব্যাপার এই যে শিক্ষা প্রশিক্ষণের ওপর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে এ দেশের শিশুদের বাধ্য করা হয় যখন এখানের ছেলে-মেয়ে চতুর্থ শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে যায়।

গ্রেড পয়েন্ট স্কোর মিনিমাম হতে হবে ২.৩৩, যারা এলিট বা এদেশের সেরা স্কুলে যাবে। যদি কেউ ২.৩৪ পায়, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হবার পর পরই তিন দিনের মধ্যে আবার পরীক্ষা দেবার সুযোগ পায় তারা। এ পরীক্ষার ফলাফল কমপক্ষে ২.০ হলে এলিট বা সেরা স্কুলে পড়তে পারবে। এলিট বা সেরা স্কুল দ্বাদশ পর্যন্ত এবং তারপর তারা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ইচ্ছা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী। বাকি সব যারা ২.৩৩ পেলো না, তাদেরকে সাধারণ স্কুলে যেতে হবে।

সাধারণ স্কুল দুই প্রকার, একটি দশম শ্রেণী অব্দি, অন্যটি নবম শ্রেণী অব্দি। যারা নবম শ্রেণী অব্দি প্রশিক্ষণ নেয় এদের বেশির ভাগই কর্মরত সমাজের বিভিন্ন ধরনের কাজ কর্মের সঙ্গে যা সত্যিকার অর্থে বলতে হয় দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূরর্ণ।

মাক্সিম খুবই ভালো করছে স্কুলে এবং আগামী বছর তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে সে কী হতে চায়। ছোট মেয়ে জেনিনও এলিট বা সেরা স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছে।

বাবা-মা বেশ স্বস্তির ভিতর আছে। যেহেতু তারা দু’জনই এলিট বা সেরা স্কুলের ছাত্রী। প্রতি সপ্তাহে তাদের পরীক্ষা থাকে কোন না কোন বিষয়ের ওপর এবং ক্লাস ফোর অব্দি শুধুই জার্মান ভাষার ওপর ১০০% গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এদের ধারনা জার্মান ভাষাতে ভাল দক্ষতা না থাকলে পরে জীবনে তারা ভাল করতে পারবে না। ক্লাস ফাইভ থেকে ইংরেজি এবং সিক্স থেকে তারা অন্য ভাষা পছন্দ করে।

মাক্সিম এখন ল্যাটিন ভাষা পছন্দ করেছে হয়ত তার চিন্তায় রয়েছে ডাক্তারি পড়বে বিধায় ল্যাটিন ভাষা কাজে লাগবে। স্প্যানিশ হবে তার চতুর্থ ভাষা যখন সে ক্লাস এইটে উঠবে। এতে পরিস্কার যে এরা শুরু থেকে পৃথিবীর যে কোন দেশের সুযোগ সুবিধা বা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত।

অন্যভাবে বলতে হয় তারা নিজেদের প্রস্তুত করছে তাদের জ্ঞান ভান্ডারকে ভবিষ্যতের জন্য কাজে লাগাতে হবে তাই।

মাক্সিমের স্কুলের এক শিক্ষকের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তিনি পরিচয়ে বললেন, ওয়াও, বাংলাদেশ! বাংলাদেশের মেয়ে আমাদের স্কুলের গর্ব। যদিও মাক্সিম জন্মগতভাবে জার্মানির হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশেকে তারা ভক্তির সঙ্গে দেখছে যা জানতেই বুক ভরে গেল।

মাক্সিম ও জেনিনকে দেখে মনে হলো তারা জীবনের শুরুতেই মেনে নিয়েছে যে পৃথিবীতে এসেছি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্য দিয়ে এই পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়তে হব। একই সঙ্গে আনন্দ, ভালবাসা এবং মজাও করতে হবে। যাচ্ছে আগামী সপ্তাহে তারা প্যারিসে ছুটি কাটাতে

মাক্সিম ও জেনিনের বাবা-মা তৈরি করছে তাঁদের জীবন সাধারণ জার্মানিদের মতই। তাদের বাসা-বাড়ির সঙ্গে রয়েছে একটি সুন্দর সামার কটেজ, যা কিছুটা ভিন্ন জার্মানিদের সামার কটেজের তুলনায়।

এখানে ঢুকতেই মনে পড়ে গেল বাংলার গ্রাম যেখানে রয়েছে নানা ধরনের বাংলা শাক-সব্জি থেকে শুরু করে ফুলে ফলে ভরা যেন এক “লিটল বাংলাদেশ”। সব মিলে বেশ আপ্লুত হলাম এমনটি দেখে। মনে হচ্ছিল যেন আবার এসেছি ফিরে সেই বাংলার কোলে।। স্বপ্ন মনে হচ্ছে বাস্তবে রুপান্তরিত হতে চলছে।

যখন মিউনিকে লিটল বাংলাদেশ দেখলাম, একই সঙ্গে ভাবতে ইচ্ছে করছে এভাবে মাক্সিমের মত লাখো লাখো ছেলে-মেয়েরা ছড়িয়ে দিক সারা পৃথিবীতে সোনার বাংলার প্রতিচ্ছবি। অনুপ্রাণিত করুক দেশের লক্ষ লক্ষ পরিবার, যারা নিয়মিত মাক্সিমের পরিবারের মত সুন্দর সুন্দর কাজের সঙ্গে গড়ে তুলছে তাঁদের জীবন, তাদের পরিবার।

ভালো কাজের মধ্য দিয়ে গর্বিত করছে তারা তাদের পরিবার এবং সেই ফেলে আসা মাতৃভূমিকে। মা-বাবা সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের যে অ্যাসিভমেন্ট বা সাকসেস দেখাচ্ছে তাও ছড়িয়ে পড়ুক দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমে।

অবৈধ বা অসৎ পথে উপার্জিত অর্থ সম্পদ কখনও ভালবাসা বা আনন্দের স্টোরি তৈরি করে না বা গর্ব করে প্রকাশ করার মত নয়। যা গর্ব করার মত যেন তাই করতে সক্ষম হই আমরা সর্বক্ষণে। সারা বাংলাদেশ তুলে ধরুক হাজারও মোটিভেটেড পূর্ণ স্টোরি, যা নিজেকে এবং অন্যকে অণুপ্রাণিত করে। এমনটি প্রত্যাশায় আমি রহমান মৃধা মিউনিক, জার্মানি থেকে ফেরার পথে।

লেখক : জার্মানপ্রবাসী সাংবাদিক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!