মহাকাশেই হারিয়ে গেছেন যে নভোচারী
কয়েক হাজার মাইল ভ্রমণে জীবনের ৩১ দিন কাটিয়েছিলেন মহাকাশেই । সে মহাকাশেই চিরতরে হারিয়ে যান তিনি। তাই তাঁর মুখেই মানায়, “আমি কোনও নির্দিষ্ট দেশের নয়, সৌরজগতের নাগরিক।” তাঁর নামে একটি গ্রহাণু ও একটি উপগ্রহের নামকরণ করা হয়েছে। মঙ্গল গ্রহে একটি পাহাড়েরও নাম রাখা হয়েছে ‘চাওলা হিল’। ভারতের প্রথম আবহাওয়া উপগ্রহের নাম দেওয়া হয় কল্পনা-১। তাঁর নামে একটি সুপার কম্পিউটারও আছে। যে সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়েছেন, সেখানকার ডর্মিটরি, প্রবেশপথের নামকরণ হয়েছে তাঁর নামে। তাঁর নামে চালু হয়েছে বৃত্তি, পদক, সম্মান। পেয়েছেন বহু মরণোত্তর সম্মান ।
ছোটবেলায় বিমান দেখার বায়না করতেন কল্পনা। তাঁদের বাড়ির কাছেই ছিল কার্নাল ফ্লাইং ক্লাব। বিশেষ অনুমতি নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন বাবা। সেদিন বিমানে ঘোরার সময় মেয়ের মুখে আনন্দের প্রতিচ্ছবি এখনও মনে করতে পারেন বানারসী লাল চাওলা। বলেন, ‘সেদিনই বুঝেছিলাম, ও ওড়ার জন্যই জন্মেছে। নক্ষত্রদের মাঝেই ওর স্থান। নাসায় যখন নির্বাচিত হল, মজা করেই বলেছিল, মহাকাশে কেউ ওকে অপহরণ করবে। এখন মনে হয়, সে কথাটাই বোধহয় সত্যি!’
১৯৬১ সালের ১৭ মার্চ হরিয়ানার কার্নালে একটি গোঁড়া পরিবারে জন্ম কল্পনা চাওলার। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আমেরিকা যান ১৯৮২ সালে। দু’বছর টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করে মাস্টার অফ সায়েন্স ডিগ্রি পান। আরও চার বছর পরে, ১৯৮৮ সালে নাসায় যোগ দেন।
কয়েক বছরেই স্বীকৃত পাইলট হয়ে ওঠেন কল্পনা। পরে নাসা রিসার্চ সেন্টারে ওভারসেট মেথডসের ভাইস প্রেসিডেন্টও হন। বাণিজ্যিক উড়ান চালানোর অনুমোদন ছিল তাঁর। সামুদ্রিক বিমান এবং মাল্টি-ইঞ্জিনের প্লেন চালানোরও লাইসেন্স ছিল তাঁর। পরে ফ্লাইট ইনস্ট্রাকটরও হয়েছিলেন তিনি।
এর মধ্যেই বিয়ে করেন মার্কিন লেখক জাঁ-পিয়ের হ্যারিসনকে। সে সুবাধে ১৯৯১ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব পেলে নাসার অ্যাস্ট্রোনট কোরের সদস্য স্বীকৃতি পান কল্পনা। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর পাড়ি দেন প্রথম মহাকাশ অভিযানে। মহাকাশযান কলম্বিয়া এসটিএস ৮৭-তে মিশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ৩৭২ ঘণ্টা মহাকাশে কাটান তিনি। পৃথিবীর কক্ষপথে ২৫২ বার পরিক্রমা করেন। ১০০ লক্ষ মাইলেরও বেশি ভ্রমণ করেন মহাকাশে। তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেন।
২০০০ সালে কলম্বিয়া এসটিএস ১০৭-এর মহাকাশ অভিযানে ফের মহাকাশে যাওয়ার সুযোগ পান কল্পনা। নানা কারণে পিছিয়ে যাওয়ায় শেষমেশ ২০০৩ সালের ১৬ জানুয়ারি মহাকাশযাত্রা করেন কল্পনারা। তিনি ছাড়াও আরও ছয় মহাকাশচারী ছিলেন ওই অভিযানে।
২০০৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ফেরার পথে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল পর্যন্ত পৌঁছেও গেছিল তাঁদের মহাকাশযান। আর কয়েক মিনিটেই হয়তো ছুঁয়ে ফেলতেন পৃথিবীর মাটি। তখনই টেক্সাসের উপরে টুকরো টুকরো হয়ে যায় গোটা মহাকাশযান। সাত জন অভিযাত্রীই মারা যান।
পৃথিবীর মাটি ছুঁতে বাকি ছিল মাত্র কয়েক মিনিট। তখনই মুহূর্তের বিস্ফোরণে ছাই হয়ে যায় মহাকাশযান। আর তার ভিতরেই অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে শেষ হয়ে যান ভারতের প্রথম মহিলা মহাকাশচারী কল্পনা চাওলা। সারা পৃথিবী তাঁকে এই নামে চিনলেও, তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের আদরের মন্টো। মাত্র ৪২ বছরে শেষ হয়ে যায় তাঁর জীবন।
ইন্দো-মার্কিন এই সাহসিনীর শেষ ইচ্ছে ছিল, মৃত্যুর পর তাঁর দেহভস্ম যেন হিমালয়ের বুকে বা জিওন ন্যাশনাল পার্কে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মেয়ের ইচ্ছে পূর্ণ করেছিলেন বাবা।
মেয়ের চিতাভস্ম যখন আমেরিকার ‘জিওন ন্যাশনাল পার্কে’ ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন, তখন পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন মার্কিন মহিলা। অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন কল্পনারবানারসী লাল চাওলা। তাঁর মেয়ে কল্পনা চাওলার মৃত্যুর খবরে যিনি এমন কাঁদছেন, তিনি চাওলা পরিবারের একেবারেই অপরিচিত।
‘কার্নাল থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, এ ভাবেই মানুষ আমার মেয়েকে ভালোবেসেছে। ওঁর মৃত্যুর পর বুঝতে পেরেছি, কত অসংখ্য মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে মেয়ে, কতজনকে অনুপ্রাণিত করেছে! ও শুধু আমার মেয়ে নয়, ভারতের মেয়ে, আমেরিকার মেয়ে,’ কথাগুলো যখন বলছিলেন, আনন্দে ও গর্বে চকচক করছিল ৮৬ বছরের বানারসী লাল চাওলার চোখ দু’টো।
ইন্দো-মার্কিন মহাকাশচারী কল্পনা চাওলাকে নিয়ে সম্প্রতি একটি তথ্যচিত্র বানিয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। তাদের ‘মেগা আইকনস টিভি সিরিজে’র অংশ হিসেবে ৪৫ মিনিটের এই তথ্যচিত্রের জন্য কল্পনার বাবা-মা, ঘনিষ্ঠদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার মুম্বইয়ের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রথম সে তথ্যচিত্র দেখেন কল্পনার বাবা। বড় পর্দায় মেয়ের জীবনী বাবাকে আরও গর্বিত করেছে। তাঁর কথায়, ‘আমি চাই কল্পনার কাজের মাধ্যমে সারা বিশ্ব উপকৃত হোক। জীবদ্দশায় কল্পনা মানুষকে বহু ভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। কার্নালের টেগোর বাল নিকেতনের পড়াশোনা থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা। নিজের বক্তৃতার মাধ্যমে বহু মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে সে। তথ্যচিত্রটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও বড় স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করবে।’
বানারসীর কথায়, ‘হিউস্টনে মেয়ের বাড়িতে অপেক্ষা করছিলাম। কখন আমার মেয়েটা মহাকাশ থেকে বাড়ি ফিরবে। সে ফিরল না, এল মৃত্যু সংবাদ।
ছোটবেলা থেকেই বিমানের ব্যাপার খুব আগ্রহ ছিল মেয়েটার। ও তারাদের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকত। এখন মনে হয়, ও যেন তারাদের দেশেই বিলীন হয়ে গিয়েছে।’
ছোটবেলায়, বাড়ির কাছেই কার্নাল ফ্লাইং ক্লাবে কল্পনার প্রথম বিমান দেখার সেই স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল বাবার চোখে, ‘বাড়ি থেকে সাইকেল চালিয়ে গিয়েছিলাম। সামনে কল্পনা, পিছনে বসে ছেলে। ক্লাবে পৌঁছে সাইকেল রাখার আগেই বিমানের দিকে দৌড়ে গেল কল্পনা। তার পর সেখানের অফিসারকে কত প্রশ্ন— বিমান কী ভাবে ওড়ে? কী ভাবে কাজ করে?’
সৌরজগতের নাগরিক হিসেবে নিজের পরিচয় দেওয়া কল্পনার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল ভারত জুড়ে। আজও ভারতের মহাকাশ চর্চায় তাঁর অবদান ভোলেননি কেউ। তিনি বলেছিলেন– “তোমরা যখন নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে চেয়ে থাকবে, তখন তোমাদের মনে হবে তোমরা কোনও নির্দিষ্ট জায়গা থেকে নয়, এই সৌরজগৎ থেকেই এসেছো।”