আকাশের আরশি থেকে

মার্কিন বোয়িং-৭৪৭ এখন আকাশ পথ দাবড়ানো সবচেয়ে বড় বিমান। জেদ্দা থেকে আমরা সে বিমানেই সওয়ার হয়েছিলাম। বিমানটির দু’তলায় ভ্রমণ করার একটি ইচ্ছা মনে পোষণ করে রেখেছিলাম। এর কারণ হল জেদ্দা যাওয়ার পথে এ বিমানেরই নিচ তলায় জরুরি নির্গমন দরজার কাছে বসতে পেরেছিলাম। নিচ তলা দেখেছি। ভবিষ্যতে আবার কোথাও বিমান বিদ্যা পড়ানোর ইচ্ছা মনে মনে ছিল। তাই এত বড় বিমানের উপরের তলাটি দেখার জন্য এবং ভবিষ্যতের অজানা ছাত্রদের মাঝে আমার অভিজ্ঞতা বয়ানের তাকিদে দু’ তলার সিঁড়ির নিচে দাঁড়ানো একজন বিমানবালাকে আমার ইচ্ছার কথা জানালাম। আমার অতীত শিক্ষকতার কথা বললাম। কলেজ অব এভিয়েশন টেকনোলজি আর এন আই ই টি তে এক সময় বিমান বিদ্যা বিষয়ের সি আই ছিলাম এ পরিচয় দেওয়াতে জেদ্দা যাওয়ারকালে মিসরীয় কেবিন ক্রু শীহান আমাকে শিক্ষকের আসনে বসাল। অতিরিক্ত খাতির-যত্ন করল। চা-কফি এনে দিল। সে যথার্থই একজন ভাল বিমানবালা।

বোয়িং -৭৪৭ উড়োজাহাজের ভিতরের অংশ
বোয়িং -৭৪৭ উড়োজাহাজের ভিতরের অংশ

ফেরার পথেও হতাশ হতে হল না। আরব কোন দেশের বিমানবালা আমাকে উপরে যাওয়ার অনুমতি দিল। তাঁর সাথী ইন্দোনেশীয় বিমানবালাও পথ ছেড়ে দিল। আসলে ওরা সকলেই আমার কলেজ অব এভিয়েশন টেকনোলজির কেবিন ক্রু কোর্সের ছাত্রীদের মত। যাত্রার উভয় পথেই আমার আগ্রহী চোখ আমার ছাত্রী বা নিদেন পক্ষে বাংলাদেশের কাউকে খুঁজছিল। শীহানকে এমন কারো কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে কারো খোঁজ দিতে পারেনি। শুনেছিলাম আমার ছাত্রী জান্নাতুল মিন্নাত কোন এয়ার লাইন্সে চাকরি নিয়েছে। জানিনা কোথায়? তাঁর একটি কষ্টের মন্তব্য মনে গেঁথে আছে, “স্যার, কেবলত একজন মেজর হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। হতেত পারলাম না”। সে বলেছিল তাঁর দুঃখের কথা। কোন এক বি এম এ লং কোর্সের ক্যাডেট ছিল সে। সে নারী হয়েও টিকে থাকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছিল। বিধি বাম। প্রশিক্ষণকালে পায়ে আঘাত। চিকিৎসা আর পরে বোর্ড আউট। অতপর কলেজ অব এভিয়েশন টেকনোলজিতে কেবিন ক্রু কোর্সে ভর্তি। যাক সে গল্প। স্বপ্ন দেখা মানুষের সব স্বপ্ন পুরো না হলেও কোন না কোন স্বপ্নত পুরো হয়। আমি তাঁকে বলেছিলাম তোমার বাবাত ইতালিতে থাকেন, এক সময় হয়ত তোমার বিমান মাঝে মাঝেই সেখানে ল্যান্ড করবে।

বিমানযাত্রা বিষয়ে ফিরে আসি। সকালের সোনা রোদে বিমানের জানালার আরশি দিয়ে নিচে তাকালাম। সম্ভবত বিমান তখন ভাঁটা কালের লোহিত সাগরের কোন উপকূলের উপর দিয়ে উড়ছে। অল্প পানি সর্বত্র। আর কোথাও কোথাও উঁচু চরের মত নজরে আসছিল। কোথাও জমে থাকা পানির মত মনে হচ্ছিল। অবচেতন মনের ঢালি থেকে ভেসে এসেছিল কোরাঙ্গি ক্রিকের স্কুল অব এরোনটিক্স সংলগ্ন আরব সাগর সৈকতের ভাটাকালীন অবস্থা। ছুটির দিনে কখনো রিসালতের সাথে কখনো বা একা ভাঁটার সময় সাগরের উপকূলে নেমে গেছি। মাড স্কিপ্পারের পিছে লেগেছি।পাথরে কলোনি বানানো প্রবালদের রাজ্যের ফাঁকে লাল কাঁকড়াদের পালাতে দেখেছি। করাচির এ সৈকত থেকে ভারতীয় সাগর সীমানা দূরে নয়।

সাগরের মাঝে দূরের রেইন ফরেস্ট দৃষ্টি সীমায়। আকাশে সিগালের উড়া উড়ি।কখনো সে দিকে কিছু দূর হেঁটে গেছি। মাঝে মাঝে জমে থাকা পানিতে সাগরের মাছের হাজারো পোনার ঝাঁক। আমি জানি এখন ওদের বংশধরদের কেও কেও বেঁচে থাকতে পারে তবে চিরকালীন বৈরী সাগরে ওরা আর কেও বেঁচে নাই। সাগর – মহাসাগরে ছোটরা বড়দের খাবার।সাগর, মহাসাগর, নদী, খাল, মরু আর বন-জঙ্গলে এটিই প্রকৃতির নিয়ম। সেটিই স্বাভাবিক।কোনভাবে টিকে থাকাটা যেন দুর্ঘটনা। বেঁচে থেকে বড় হলে ওরা চলে আসতে বাধ্য হয় মানুষের খাবার টেবিলে। বিমান চালকের ঘোষণা এল, “জানালা বন্ধ করে দিন”। দেখলাম বিমান বালা তৎপর। বিমানের আরশি ভেদ করে চোখ ধাঁধানো প্রচণ্ড রোদ জানালার পাশের যাত্রীদের চোখে-মুখে। সূর্য তার তপ্ত তেজে আকাশে রাত অবসানের জানানি দিল যেন। বিমান চালক জানেন রোদের এ তেজ যাত্রীদের জন্য ক্ষতিকর।

Travelion – Mobile

জানালার আরশির উপর ধাতব ঢাকনা টেনে দিলাম। কেবিনে আবছা আলো আঁধারির খেলা । রাত জাগা যাত্রীদের অনেকে তখন নাক ডাকা ঘূমে। আমিও এক সময় ঘুমের রাজ্যে। দূরাগত কোন আওয়াজ যেন শুনা গেল। দু’তলার জানালার পাশে বসে ঘূমালে কি চলে? চোখ খুললাম, দেখলাম হবু ডঃ মইন।তিনি বলেছিলেন, আমার জন্য সিট রাখবেন। তিনি চলে গেলেন। আমি আবার ঘুমের জগতে। কেও আমার শরীরে হাত রাখলেন। চোখ খুল্লাম। দেখলাম হবু ডঃ মুর্তজা। বন্ধুর কাছে শোনে আমার খবর নিতে এসেছেন। মক্কা ও মদিনায় একই কামরায় ছিলাম। বিমানেও পাশাপাশি বসলে ভাল হত। যাক আমার পাশে যারা সিট নেন তাঁরা ছিলেন একজন চিকিৎসক ও তাঁর মা। তাঁরাও আমাদের গালফ হজ্জ এজেন্সির মাধ্যমে হজ্জে গিয়েছিলেন।আর আমার মনে সুপ্ত আশা থাকলেও হবু গবেষকদের খোঁজে আনা সম্ভব ছিলনা। আকাশের উড়ন্ত আরশি নগরের জনসমুদ্রে ওরা কোথায় ঠাই নিয়েছিলেন কে জানে?

নীল নদ অববাহিকা ও লোহিত সাগর
নীল নদ অববাহিকা ও লোহিত সাগর

একজন বিমানবালা এসে জানালা খোলে দিতে বল্ল। আমার চেষ্টা করার পূর্বে সে নিজেই জানালার আরশির ঢাকনা সরিয়ে দিতে সচেষ্ট হল। আমিও সহায়তা করতে চাইলাম। বিমানে এখন আলোর রাজ্য। আকাশের আরশি নগরের বাইরে তাকালাম। নিচে মেঘের রাজ্য। জানলাম বিমান তখন বাংলাদেশের আকাশে। গতি যেন কমে গেছে। জানালা দিয়ে বাংলার মাটি দেখতে চাইলাম। আমরা মেঘের নিচে তখন। ক্রমে নদী, গাছ- পালা, ঘর-বাড়ী, রাস্তা-ঘাট নজরে আসতে থাকল। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সকল কিছুই যেন পানির নিচে।এরও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। তত্ত্ব অনুসারে বায়ু আর তরল পদার্থ একই পর্যায়ভুক্ত। বাতাসের সমুদ্রে প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলা বিমানের জানালার আরশি ভেদ করে মানুষের দৃষ্টিকে মাটি পর্যন্ত যেতে বহু পথ অতিক্রম করতে হয়। দৃষ্টি বিভ্রমের সম্ভাবনা থেকেই যায়।

পানি মরীচিকার নিচে ডুবা বাংলাদেশকে পাশের সিটে বসা স্বল্পভাষী ডাক্তার সাহেবকে দেখালাম। বিমান তখন তুরাগ নদীর উপর। আর একটু পরেই তা রানওয়ের দিকে ছুটবে।সউদিয়ার আরব বেদুঈন, যাযাবর আকাশ জাহাজটির একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। দিনটি ছিল ১৪ অক্টোবর, ২০১৪।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!