২০১৯ : বোয়িংয়ের বছর ছিল না

‘বোয়িং’। যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ প্রস্তুতকারক সংস্থা। ১৯১৬ সালের ১৫ জুলাই যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম এডওয়ার্ড বোয়িংয়ের “আরও ভাল কিছু গড়ে তুলুন” দর্শনকে বুকে ধারণ করে গত এক শতাব্দীতে বোয়িং হয়ে ওঠে বিশ্বের বৃহত্তম উড়োজাহাজ প্রস্তুতকারক ।

বৃহত্তম উত্পাদনকারী ও রফতানিকারী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের দেড় শতাধিক সরকারী-বেসরকারি বিমানসংস্থার সাথে যুক্ত হওয়ার সাফল্য রয়েছে বোয়িংয়ের।

আকাশযান নির্মাণশিল্পের বাণিজ্য যুদ্ধের লড়াইয়ে বোয়িং প্রতিপক্ষ ইউরোপিয়ান উড়োজাহাজ প্রস্তুতকারক এয়ারবাস । ছোট ছোট উড়োজাহাজ থেকে শুরু করে বড় বড় জাম্বো জেট বা যুদ্ধবিমান-সব জায়গাতেই এ দু-প্রতিপক্ষের লড়াইটা দীর্ঘদিনের। কখনও এয়ারবাস এগিয়ে যায়, কখনও বোয়িং।

Travelion – Mobile

২০১৯ সালে এগিয়ে গেছে এয়ারবাস। সাফল্যের তালিকাটা অনেক দীর্ঘ হলেও এ বছর অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে বোয়িং।

বলা যায়, খুব খারাপ একটা বছর গেল বোয়িংয়ের। কোনভাবেই বছরটি উপভোগ করতে সক্ষম হয়নি বোয়িং। এর পেছনে প্রধান কারণ ৭৩৭ ম্যাক্স দুর্ঘটনাকে ধরা হলেও আছে আরও ইস্যু।

চলতি বছর ৭৩৭ ম্যাক্স দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে ৭৭৭ এক্স পরিকল্পনায় বিলম্ব কিংবা মহাকাশ মিশন ব্যর্থ আর সবকিছুর দায়ে সিইও’র বরখাস্ত-সবই ছিল দূর্ভাগ্যজনক।

৭৩৭ ম্যাক্স দূর্ঘটনা:
ইন্দোনেশিয়ায় ৭৩৭ ম্যাক্স দূর্ঘটনা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক দূর্ঘটনার ক্ষেত্রেও প্রথমে উড়োজাহাজ চালনায় অদক্ষতাকে দায়ী করা হয়েছিল। গেল বছর, ইন্দোনেশিয়াতে বোয়িংয়ের ৭৩৭ ম্যাক্স ৮ দূর্ঘটনায় যখন সব যাত্রী মারা যায় তখন এ নিয়ে সারাবিশ্বে শুরু হয় তোলপাড়। সেই ঘটনার পরপরই যখন দূর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছিল তখনই আবার ইথিওপিয়াতে তাদের আরেকটি উড়োজাহাজ একইভাবে দূর্ঘটনায় পড়ে।

বিশ্বজুড়ে গ্রাইন্ডিং হওয়া সত্বেও ৭৩৭ ম্যাক্সের উৎপদন অব্যাহত রেখেছিল বোয়িং কোম্পানী
বিশ্বজুড়ে গ্রাইন্ডিং হওয়া সত্বেও ৭৩৭ ম্যাক্সের উৎপদন অব্যাহত রেখেছিল বোয়িং কোম্পানী

এইসব দূর্ঘটনার জেরে সারা বিশ্ব বোয়িংকে বর্জন করে যদিও বোয়িং এবং ফেডারেল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষে এর শুভাকাঙ্খিরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই পথে এগোয়নি। তবে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে পাইলটের ভুল নয় বরং বিমানের ক্ষতিগ্রস্ত সেন্সরে এমসিএস সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ায় বিমানটি দূর্ঘটনায় পড়েছিল।

সেই থেকে বোয়িং তাদের এই উড়োজাহাজের দুর্বলতা আদৌ কাটিয়ে উঠতে পারেনি কিংবা ৭৩৭ ম্যাক্স বর্জনের বিশ্বব্যাপী সিদ্ধান্তেরও কোন হেরফের ঘটাতে পারেনি। তাই এখন তাদের কাছে পুরো ৪০০ বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমান রয়েছে যাদের ডানা মেলে কোথাও উড়ে যাওয়ার আর সুযোগ নেই।

উৎপাদিত এসব উড়োজাহাজ সরবরাহ করতে না পারায় যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের কারখানায় উড়োজাহাজের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে সংরক্ষনাগারে এখন আর জায়গা হচ্ছে না। অগত্যা কর্মকর্তাদের কার পার্কিং এরিয়াতে উড়োজাহাজ রাখতে হয়েছে।এর পরিপ্রেক্ষিতে বোয়িং আগামী জানুয়ারি মাসে বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজ উৎপাদন বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে।

৭৩৭-নেক্সট জেনারেশন এর দুর্বলতা;
বোয়িংয়ের পুরনো মডেলের বিমান ৭৩৭-৮০০ নেক্সট জেনারেশনও ২০১৯ এ তার নানা সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। একটি বিমানসংস্থার এই জনপ্রিয় মডেলের একটি উড়োজাহাজের মূল অংশের মাঝখানে ফাটল পাওয়ার পর এই বাকি উড়োজাহাজগুলোকেও ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েও যেতে হয়েছে। এর অর্থনৈতিক ও জনসংযোগের বিষয় সামাল দিতে বোয়িংকে অনেক টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে। এতে এক সময়ের পরীক্ষিত উড়োজাহাজটির উপর যাত্রীদের আস্থা কমেছে এবং বোয়িং কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা বেড়েছে।

৭৭৭ এর পরীক্ষা জটিলতা:
বোয়িং ৭৭৭ এক্স, যা উন্নতমানের বোয়িং ৭৭৭ এর আধুনিক প্রজন্ম হিসেবে পরিচিত সেটিও থমকে গেছে ইঞ্জিন জটিলতায়। এছাড়াও উড়োজাহাজটির একটি চাপ নির্ণয় পরীক্ষাও ভেস্তে গেছে বিস্ফোরণ জটিলতায়। যদিও ইঞ্জিন জটিলতা বোয়িংয়ের কোন সমস্যা নয় এবং পরীক্ষার ব্যর্থতার জন্য একটি উড়োজাহাজের জীবনচক্রের স্বাভাবিক চাপ নেয়ার বিষয়টি দায়ী। তবে সবমিলিয়ে জনসংযোগের নেতিবাচক দিকই এই মার্কিন উড়োজাহাজ উৎপাদকদের জন্য কাল হয়েছে। এর কারণে লুফথানসা এবং এমিরেটসসের মত প্রতিষ্ঠান এই ধরনের উড়োজাহাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
বোয়িং ৭৮৭ জটিলতা:
নানা ধরনের সংকটে জর্জরিত বোয়িং ৭৮৭ প্রোগ্রাম। এই সংকটগুলো এটির নির্মাণ মান থেকে শুরু করে অক্সিজেন মাস্ক ঠিকমত কাজ না করা পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। তাছাড়া বোয়িংয়ের ৭৮৭ বজ্রপাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন নানা আলামত মিলেছে, সাথে যুক্ত হয়েছে ইঞ্জিন জটিলতার বিষয়টি যদিও সমস্যাটি ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক রোলস রয়েস-এর দিক থেকে তৈরি হয়েছে।

কমে এসেছে অর্ডার:
বোয়িং এসব সমস্যা আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে অন্যান্য সব বিষয় সামলানোর কোন সময় পায়নি, যার কারণে তাদের সামগ্রিক কার্যকলাপে তৈরি হয়েছে নানা ধরনের ঘাটতি।

বোয়িংয়ের এসব জটিলতা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে তাদের সামগ্রিক অর্ডারে। প্যারিস এয়ার শো, দুবাই এয়ার শোতে এয়ারবাস অর্ডার পাওয়ায় তাক লাগিয়ে দিলেও এ বছর বোয়িংয়ের নতুন অর্ডারের হিসেব খুবই সামান্য। দুবাই এয়ার শোতে প্রতিদ্বন্দী ‘এয়ারবাস’ ‘বোয়িং’ থেকে আড়াই গুন বেশি অর্ডার পেয়ে বাজিমাত করে ।

তাই, প্রকৃত সংখ্যার দিকে তাকালে এই উড়োজাহাজ নির্মাণ সংস্থাটির লাভের চাইতে ক্ষতির পরিমাণই বেশি হয়েছে।

মহাকাশযান ‘দ্য স্টারলাইনার’
‘মহাকাশ ভ্রমণ’র বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনার কথা বেশ ঘটা করেই ঘোষণা করেছিল বোয়িং কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় এই মিশন। গত নভেম্বরে প্রথম যাত্রীবাহী মহাকাশযান ‘দ্য স্টারলাইনার’ সফলভাবে উক্ষেপন করলেও এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছাতে পারেনি। মিশন অসম্পূর্ণ রেখেই পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয় নাসার মাধ্যমে পাঠানো বোয়িংয়ের নতুন মহাকাশযানটি।

৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজ তৈরি বন্ধের ঘোষণাটি হতাশার হলেও একই সপ্তাহে এসেছে আশারআলো হয়ে এসেছিল ‘ দ্য স্টারলাইনার’ মিশনের খবর। কিন্তু মিশন ব্যর্থ হওয়ায় আবারও পিছিয়ে পড়তে হল বোয়িংকে।

বোয়িংয়ের সিইও ডেনিস মুইলেনবার্গ
বোয়িংয়ের সিইও ডেনিস মুইলেনবার্গ

সিইও বরখাস্ত-:
বোয়িংয়ের দু:সংবাদের সবশেষ সংযোজন হল বছরের একেবারে শেষ সময়ে এসে এরসিইও’র বরখাস্ত হওয়া। । বোয়িং কর্তৃপক্ষের নতুন পরিকল্পনার কারণে এর সিইও ডেনিস মেলিনবার্গের সাথে জটিলতা তৈরি হয়। “ বোয়িং কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছিল তাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য এর নেতৃত্বের পরিবর্তন ছাড়া আর তেমন কোন উপায় নেই। তবে সিইও’র পদত্যাগের আগেই তাদের মহাকাশযান প্রোগ্রাম একটি জটিলতায় পড়ে যা তাদের প্রতিযোগি স্পেস এক্সকে আরো ভাল অবস্থানে নিয়ে যায় আর নাসার কাছে আস্থা কমায়।

তারপরও যারা বোয়িংকে ভালবাসে তাদের প্রত্যাশা অতীতের সব দুর্বলতা আর বাঁধা কাটিয়ে সংস্থার কর্মঠ সদস্যদের সর্বোচ্চ পরিশ্রমে ২০২০ সালে আবার ঘুরে দাঁড়াবে বোয়িং, গড়বে পরবর্তী প্রজন্মের উড়োজাহাজ।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!