সোনা চোরাচালান : সুইপার থেকে ধনকুবে দুই প্রবাসী

যুগান্তর প্রতিবেদন

হতদরিদ্র পরিচ্ছন্নতাকর্মী (সুইপার) থেকে রীতিমতো রাতারাতি ধনকুবের বনে গেছেন দুই প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী। সম্পদের পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে গেছে তাদের আসল পরিচয়। স্বর্ণ চোরাকারবারে জড়িত দুই প্রবাসী কর্মীর বিত্তশালী হয়ে ওঠার গল্প কল্পকাহিনিকেও হার মানিয়েছে।

এরা হলেন সিঙ্গাপুরে স্থায়ীভাবে বসবাসরত দুই বাংলাদেশি। আবুল হাসেম ও আলমগীর হোসেন। দুজনেই সিঙ্গাপুরে এক সময় সুইপারের কাজ করতেন। কিন্তু স্বর্ণ চোরাচালানের সুবাদে তাদের ভাগ্যের চাকা খুলতে বেশি সময় লাগেনি। তারা এখন হাজার কোটি টাকার মালিক।

সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ধরে হাসেম আলমগীর চক্র সুকৌশলে ঢাকায় স্বর্ণের চালান পাচার করে আসছিলেন। কিন্তু গত বছর তাদের ৩২ কোটি টাকার একটি চালান ধরা পড়লে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। কাস্টমসের নথি খুঁজে দেখা যায় ইতোমধ্যে পাচার হয়েছে আরও ২শ চালান। স্বর্ণ আনতে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয় প্রায় হাজার কোটি টাকা। আরও কয়েকশ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় সরকার।

Travelion – Mobile

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাস্টমসের চোখ ফাঁকি দিয়ে একের পর এক স্বর্ণের চালান পাঠানো হলেও সংশ্লিষ্টরা অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। কাচ এবং টাইলসের স্যাম্পলের কার্টনে পাঠানো হয় স্বর্ণের বার। কিন্তু একই স্যাম্পল বারবার এলেও রহস্যজনক কারণে কাস্টমস কর্মকর্তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি।

এ সংক্রান্ত মামলার তদন্তে চক্রের মোট ৯ সদস্যকে চিহ্নিত করে পুলিশ। এরা হলেন সিঙ্গাপুরপ্রবাসী আবুল হাসেম, আলমগীর হোসেন ওরফে আজিজুল, সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলামিন ও জালাল আহম্মেদ, বিমানবন্দরের কার্গো লোডার জলিল মিয়া ওরফে জালাল, স্থপতি কাওসার আহাম্মেদ ওরফে বাপ্পী, জুয়েল রানা ওরফে সদর, আব্দুল লতিফ এবং ফরহাদুল ইসলাম ওরফে গোল্ডেন সুমন। এদের একেকজন চোরাচালানের কাজে একেক ধরনের দায়িত্ব পালন করে। এর মধ্যে ৩ জন গ্রেফতার হয়ে জেলে, একজন মারা গেছেন, বাকিরা পলাতক।

চোরাচালানের টাকায় হাসেম এবং আলমগীর দেশে-বিদেশে ব্যবসা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমিসহ অঢেল সম্পদ কিনেছেন। আছে সুপার শপ, টিকেটিং ও আদম ব্যবসা। এমনকি বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তারা সিঙ্গাপুরে নাগরিকত্ব পেতেও সক্ষম হয়েছেন।

হাসেমের কুমিল্লা শহরের পুলিশ লাইন রোডে ৯/এ সেল অর্কিড নামের কনডোমিনিয়ামে দেড় কোটি টাকার ফ্ল্যাট, দেবপুরে ৫ কোটি টাকার পেট্রল পাম্প (রাফিয়া ফিলিং স্টেশন) এবং নিশ্চিন্তপুর এলাকায় রয়েছে মোটরসাইকেল শোরুম। এছাড়া সিঙ্গাপুরের গ্যালাং এলাকায় কিনেছেন সুবিশাল সুপার স্টোর।

আলমগীরের নামে-বেনামে রাজধানীতে অন্তত ১০টি ফ্ল্যাট ও ৪টি বাড়ির মালিক। এর মধ্যে উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে একটি এবং দক্ষিণখান মধ্য ফায়দাবাদে আরেকটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পায় পুলিশ। ডেমরা সানারপাড় এলাকায় দুটি এবং গাজীপুরে তার দুটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়।

এছাড়া চক্রের সদস্য চালান খালাসকারী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আলামিন লাখ টাকার ওপরে পারিশ্রমিক পান। আরেক সদস্য দিনমজুর জালাল আহমেদ এখন দক্ষিণখানে দুই কোটি টাকায় বাড়ির মালিক। স্থপতি কাওসার আহাম্মেদ বাপ্পি চোরাচালান চক্রের নাম লিখিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। তুরাগের আহালিয়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল লতিফ স্থানীয়ভাবে সোনা চোরাকারবারি হিসাবে পরিচিত। গত কয়েক বছরে তিনি অঢেল টাকার মালিক বনে গেছেন। এলাকায় সম্প্রতি বেশকিছু মূল্যবান জমিও কিনেছেন তিনি। পুলিশ হাতে গ্রেপ্তার হয়ে।তিনি এখন কারাবন্দি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার ইন্সপেক্টর নূর মোহাম্মদ বলেন, ইতোমধ্যে আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। আসামিদের সংশ্লিষ্টতা শতভাগ প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। এখন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলেই একটি বড় চক্রের মূল উৎপাটন ঘটবে।

বিমানবন্দর থানার ওসি বিএম ফরমান আলী বলেন, বিমানবন্দরকেন্দ্রিক স্বর্ণ চোরাচালানের নেপথ্যের কারিগর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। তবে এ মামলার জড়িত গডফাদারসহ পুরো চক্রটিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। আমরা মনে করি স্বর্ণ চোরাচালান মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে এটি একটি মডেল হিসাবে চিহ্নিন্ত হবে।’

সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত আবুল হাসেম ফোনে বলেন, চোরাচালানের সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তাকে ফাঁসানো হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকার একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে তার কথা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

এদিকে সূত্র জানায়, ‘স্বর্ণ চোরাকারবারি আলমগীর পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে কখনো কুমিল্লা আবার কখনো ঢাকায় আত্মগোপনে থাকছেন। গ্রামের বাড়িতে গেলে তার ভাতিজা হারুণ মেম্বার যুগান্তরকে বলেন, আলমগীর দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুরেই বসবাস করেন। কিছুদিন আগে তিনি দেশে ফেরেন। তিনি স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত কিনা তা আমাদের জানা নেই।’
প্রতিবেদন : তোহুর আহমদ, দৈনিক যুগান্তর

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!