কামরুল হাসান জনি। সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক। ১০ বছরে প্রবাস জীবনে চাকরির পাশাপাশি শখের বশে সাংবাদিকতায় জড়িয়ে রয়েছেন। বর্তমানে দেশের প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিকে কর্মরত। সে সঙ্গে বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ইউএই’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক । দুটি উপন্যাস ও একটি ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে তার। আকাশযাত্রায় দুইপর্বে তিনি তুলে ধরেছেন প্রবাসে সাংবাদিকতার হালচাল।
আজ থেকে প্রায় আট-দশ বছর আগের কথা। যখন আরব আমিরাতে নতুন নতুন সাংবাদিকতা শুরু করি তখন চেষ্টা করেছি সিনিয়রদের খুব সান্নিধ্যে থাকার। শেখার আগ্রহ এখন যেমন, তখনও ছিল একই রকম। যদিও মফস্বলে এই পেশায় জড়িত থাকায় কয়েকটি সিঁড়ি অতিক্রম করা ছিল। তবুও পরবাস থেকে কাজ করার জন্যে একটি ভাল মিডিয়ার প্রত্যাশা ছিল সবসময়। প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তির কাছাকাছি যেতে একটু বেশি সময় ধরেই সঙ্গ নিতে হতো পুরাতনদের। দিন যত যায় রহস্য ততই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে। ভালোর প্রত্যাশায় দিন গুণতে থাকা মানুষটির চোখের সামনে কত স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল মন্দ ও অপ্রত্যাশিত কথন!
একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কয়েকজন সংবাদকর্মী মিলে যাচ্ছিলাম দুবাই থেকে আল আইন। পথে কথায় কথায় একজন সিনিয়র সাংবাদিক বললেন- ‘বড় মিডিয়ায় আসতে হলে টাকা খরচ করতে হয়, মাসে বিশ হাজারের কম নয়!’ কথাটি শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ হয়ে ছিলাম। কারণ, এমন বিষয় আমার জন্য অপ্রত্যাশিতই ছিল। জিজ্ঞাসা করলাম- এই টাকা কাকে দিতে হয় ? তিনি প্রতিউত্তর দিলেন। জবাবে বললেন- ‘ডেস্কে যারা বসেন, বার্তা বিভাগে যারা নিউজ রিসিভ করেন তাদের’।
এই কথার সত্য মিথ্যা হয়ত কেউ কেউ জানবেন। তবে অর্থ দাঁড়ালো-একটি মিডিয়ায় কাজ করতে হবে, নিজে শ্রম দিতে হবে আবার নিউজ প্রকাশ বা প্রচার করার জন্যে টাকাও দিতে হবে! বিষয়টি অদ্ভুত। কিছুদিন পর এই অদ্ভুত বিষয়টি আরেকটু পরিস্কার হলো। আরেকজন সিনিয়র থেকে জানতে পারি, টাকাটা মাঝে মাঝে উপহার হিসেবে পৌঁছাতে হয়। কেউ চেয়ে নেন, কেউ বিভিন্ন কৌশলে!
কথা হচ্ছে- টাকা দিয়ে তবে কেন সাংবাদিকতা করব? এই প্রশ্নটি একান্ত নিজের। ভাগ্যক্রমে তখন আমি বসুন্ধরা গ্রুপের পত্রিকা বাংলাদেশ প্রতিদিন এর প্রতিনিধি। নিজের সঙ্গে হিসেবের মিল খুঁজি তখন। যেখানে কাজ করছি ওই মিডিয়ার কেউ কোনোদিন টাকা চাননি। দিতে হয়নি বার্তা বিভাগের কাউকে কোনো উপহার! অথচ অত্যন্ত আন্তরিকতার সহিত সকলে সহযোগিতা করছিলেন। বছর কয়েকের মধ্যে ক্যারিয়ারে যোগ হলো টেলিভিশন চ্যানেল নিউজটুয়েন্টিফোর। সেখানেও অর্থের বিনিময় ছাড়াই নিয়মিত সংবাদ প্রচার হলো এবং এখনো হচ্ছে।
আমার চোখে বিষয়টি তখনও অত্যন্ত সরল এবং সহজ। সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে টাকা লাগে না। আমার ধারণা তখনও সঠিক, কোনো মিডিয়া সংবাদ প্রচারের নামে অর্থ গ্রহণ করে না। এরপর বাংলাদেশ প্রতিদিন ছেড়ে যোগ দিলাম দৈনিক সমকাল পত্রিকায়। জাতীয় মিডিয়ার প্রথম সারির এই পত্রিকাটিও আমার ধারণার মধ্যেই রয়ে গেল। এখানে যাদের পেয়েছি তারা যেন আরো বেশি আন্তরিক, আরো বেশি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব তাদের। কই, এদের কেউ তো টাকা চায়নি কখনো! তাহলে টাকা চায় কারা!
প্রশ্ন যখন প্রশ্নবোধক হয়ে চোখে ধরা পড়ে তখন ঘটনার ভেতরে নজর যায় সঙ্গত কারণেই! যারা টাকার গল্প করেছিলেন তাদের করা সংবাদগুলো পর্যাবেক্ষণ করলাম। বিশেষ কোনো রস নেই সংবাদে, নেই কোনো তথ্যবহুল ঘটনার বর্ণনা। কোনো কোনোটা একদম সংবাদই মনে হয়নি আমার। যা দেখা গেল, তা আদৌ একটি মিডিয়ায় প্রকাশ যোগ্য কি-না সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল! দেখলাম- টেলিভিশন সংবাদ হলে সেখানে কয়েক সেকেন্ডের একটি ফুটেজে বেশকিছু মানুষের চেহারা/ বক্তব্য প্রদানের মূহুর্ত আর পত্রিকায় ছাপানো সংবাদগুলো যেন নাম প্রকাশের ফর্দ!
বুঝতে আর বাকি রইল না। ঝামেলাটা কোথায়! মিডিয়ায় প্রকাশ বা প্রচারের অনুপযোগী হওয়ার পরও সেসব খবর বা বিজ্ঞপ্তিগুলো দায়িত্ব নিয়ে প্রচার-প্রকাশ করতে নিশ্চয়ই চাহিদা থাকতে পারে কর্তৃপক্ষের। থাকাটাও স্বাভাবিক বটে, কারণ এগুলো আদতে সংবাদ নয়! তবুও সংবাদ আকারেই প্রচার এবং প্রকাশ হচ্ছে হরহামেশা! এটি সকলের জানাও উচিত যে, মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশ বা প্রচারের জন্য অর্থ লাগে না। যা লাগে তা হলো সংবাদটি প্রচার বা প্রকাশ যোগ্য হওয়া।
শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাত নয় মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রবাসের চিত্রই এমন। যদিওবা এতে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানও খুশী থাকে। সঙ্গত কারণেই এই বিষয়টি মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে জানাজানি রয়েছে। যেটি লেখার প্রথম পর্বে একটু করে জানিয়েছিলাম। সূত্র হিসেবে দৈনিক আজাদীর প্রধান প্রতিবেদকের কিছু কথাও যোগ করেছি সেখানে। কিন্তু কথা এখানেই শেষ নয়! কথা হচ্ছে- যেই যুগ ওভাবে চলে গেছে সেটি সেখানেই শেষ। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ যেমন সচেতন, সংবাদকর্মীরাও তারচে বেশি সচেতন বলা চলে।
সংবাদ ও সাংবাদিকতার মান নিয়ে যথেষ্ট সচেতনতা এসে গেছে প্রবাসী সাংবাদিকদের মধ্যেও। প্রতিযোগিতার ন্যায় এখন এমন অনেক প্রতিভাবান সাংবাদিক তৈরি হচ্ছে প্রবাসে যারা দেশের প্রথম সারির মিডিয়ায় ভাল অবস্থানে থেকে সাংবাদিকতা করার মতই। প্রবাস থেকে পাঠানো তাদের অনেক প্রতিবেদন গুরুত্বসহকারে ছাপা হয় পত্রিকার প্রথম বা শেষ পাতায়। টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ সহ অনেক রিপোর্ট প্রচার হয় প্রায় সারাদিনই।
আপসোসের বিষয় হচ্ছে, খবর নিয়ে দেখা গেল মূলধারার প্রতিভাবান এসব সংবাদকর্মীরা প্রতিনিয়ত খেটে গেলেও পান না কোনো রকম সম্মানী বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাতা। এমনকি অনেক প্রতিনিধিকে বছরের পর বছর বিনা পারিশ্রমিককে খাটানোর পাশাপাশি স্বীকৃতি স্বরূপ দেয়া হয় না বা হচ্ছে না প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পত্র ও আইডি কার্ড। অথচ এসব বিষয়ে কথা বলার যেন কেউই নেই! অবহেলা আর দূরত্বের কাছে হার মেনে যাচ্ছে প্রবাসী সাংবাদিকতা। এসব বিষয় যেকোনো আদর্শবান ও দক্ষ সংবাদকর্মীর জন্যে সত্যিই দুঃখজনক!
দুঃখটা সেখানেও যেখানে দেখা মিলে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় দেশের মত প্রবাসেও রয়েছে সাংবাদিকদের সংগঠন। কিন্তু কার্যত সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা বা সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রটিতে তারা অনেকটাই পিছিয়ে আছেন। কোনো কোনো নেতার ব্যস্ততা থাকে নির্বাচন, পদ-পদবী ও ক্ষমতা নিয়েই। এই বিষয়টি একটু করে টেনে ধরতেই দীপ আজাদ ভাইয়ের লেখার সূত্র আনতে হয়েছে।
মূলত, ২০১০ সালের পর থেকে পরবাসে ধীরে ধীরে সংবাদকর্মীর সংখ্যা বেড়েছে। ভবিষ্যতে আরো বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ইন্টারনেটের সহজ ব্যবহার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দখলধারিত্ব, অহরহ অনলাইন নিউজ পোর্টালের জন্ম হওয়ায় নিয়মিত সাংবাদিকদের সংখ্যা বাড়ছে বলা যায়। যার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিকই পরিলক্ষিত হচ্ছে। একদিকে সংবাদ বা সাংবাদিকতার গুরুত্ব না বুঝলেও অযোগ্যরা প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়ে নানা সময় এই পেশার সুনাম নষ্ট করছে। অন্যদিকে প্রবাস থেকেও কিছু তরুণ প্রতিভাবান সংবাদকর্মী নিজেদের সেরাটুকু দিতে মরিয়া হয়ে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
কথা হচ্ছে- এখন প্রতিযোগিতার বাজার। টিকে থাকতে হলে নিজের সেরাটা দেয়ার পাশাপাশি সততা, আদর্শ, নৈতিকতার যেমন প্রয়োজন তেমনি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা, সমৃদ্ধ ও তথ্য নির্ভর সংবাদ তৈরি এবং জনগণের চাহিদা অনুযায়ী সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে নিজেকে জানান দিতে হবে। নিজের কাজের মাধ্যমে সকলের দৃষ্টি খুলে দিতে হবে। দিন বদলে গেছে, প্রমাণ করতে হবে সময় এসেছে স্ব স্ব মিডিয়া হাউজ থেকে প্রবাসে থাকা সংবাদকর্মীদের সম্মানী প্রদানের। প্রমাণ করতে হবে একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মী হিসেবে কাজ করার পুরোপুরি অধিকার এবং সামর্থ রাখেন একজন প্রবাসী সাংবাদিক। এই দায়িত্ব নিয়েই মূলধারার সংবাদকর্মীরা প্রবাসে সাংবাদিকতার দিন ফেরাতে হবে এবার। ‘প্রবাসী সাংবাদিক’ এই শব্দের অর্থগত পরিবর্তনের বার্তা পৌঁছে দিতে হবে দেশের গণমাধ্যমের কাছে।