লেবাননে ডলার সংকটে প্রবাসীদের আশার আলো!

‘খুব সকালে এখানে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি। অনেক ভিড় । টানা ২ ঘন্টা দাড়িয়ে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে পারলাম। অপেক্ষার কষ্টটা গায়ে লাগে নি। শেষপর্যন্ত মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা দিতে পারলাম। আব্বাকে বলে দিয়েছি আগামীকাল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে যেন সবার আগে আম্মাকে ভাল ডাক্তার দেখায়। আমি এখন খুব আনন্দিত।’

শনিবার (৯ নভেম্বর) লেবাননের রাজধানী বৈরুতের তাইয়ুনি এলাকায় মানি ট্রান্সফার কোম্পানি ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের সামনে চোখে-মূখে আনন্দ আর সন্তুষ্টির অভিব্যক্তি নিয়ে এমনভাবেই অনুভূতি জানালেন প্রবাসী বাংলাদেশি মামুন। দেশে টাকা পাঠানোর জন্য রাজধানী বৈরুত থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে সাঈদা জেলা থেকে তিনি এসেছেন তাইয়ুনিতে।

মামুন জানালেন, সাঈদার একটি কোম্পানীতে সীমিত বেতনে কাজ করছেন। মা-বাবা ও স্ত্রীসহ দুইজন সন্তান নিয়ে পরিবারে আছে দেশে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মা, তাই জরুরী ভিত্তিতে বাংলাদেশে টাকা পাঠাতে হবে। মালিক আগে মাসিক বেতন ডলারে পরিশোধ করলেও এবারই প্রথম লিরা (লেবাননের স্থানীয় মুদ্রা) দিয়েছে।

Travelion – Mobile

মালিকের কাছে ডলার চাইলে উত্তর আসে,’ব্যাংকে ডলার নেই, আমি কি ভাবে তোমাকে ডলার দিবো।’ তাই দেশে টাকা পাঠানোর জন্য বাধ্য হয়ে লিরা নিয়ে সাঈদা জেলায় ব্যাংক-মানি ট্রান্সফার কোম্পানীগুলোতে চক্কর দিয়েও লাভ হয় নি। কেউই লিরা নিতে চায় না। অবশেষে একজন বন্ধুর পরামর্শে পেলেন আশা আলো; তাইয়ুনির ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন।

মামুনের মত এমন অনেক বাংলাদেশি লেবাননের দূর দূরান্ত থেকে খুব সকালে দেশে রেমিটেন্স পাঠানোর উদ্দেশ্যে ভিড় জমিয়েছেন ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের এই শাখাটিতে। প্রয়োজনের ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু সবার সমস্যা একটাই; দেশে টাকা পাঠানো। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের তাইয়ুনি শাখাটি এগিয়ে এসেছে সে সমস্যা নিরসনে। তাই এখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের এত ভিড়। রয়েছে অন্য দেশের প্রবাসীরাও।

বৈরুতের তাইয়ুনি এলাকার ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের শাখায় দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা
বৈরুতের তাইয়ুনি এলাকার ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের শাখায় দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা

প্রবাসীদের সূত্রে জানা গেছে, পুরো লেবানন জুড়ে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের শাখাগুলোর বেশিরভাগই স্থানীয় মুদ্রা লিরা নিচ্ছে না। সেখানে ব্যতিক্রম বৈরুতের তাইয়ুনির শাখাটি। প্রবাসীদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে তারা। প্রবাসীদের থেকে লিরা নিচ্ছে এবং স্বল্প খরচে দেশে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।

মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরশীল লেবাননের স্থানীয় মুদ্রা লিরা দুই দশকেরও বেশি সময়ে প্রথমবারের মত মূল্যহ্রাসের ফলে দেশটির অর্থনৈতিক খাতে আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই দেশটিতে মার্কিন ডলার সংকট দেখা দেয়। ব্যাংকসহ এটিএম বুথগুলো থেকেও গ্রাহককে ডলার দেওয়া হচ্ছে না। এর মধ্যে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকট ডলার সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলে।

ডলার সংকটে সবচেয়ে বড় সমস্যায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা। মালিকরা সব সময়ই ডলারে মাসিক বেতন পরিশোধ করলেও বর্তমানে কেউই ডলারে বেতন দিচ্ছে না।। দিবেনইবা কিভাবে তারাও নিজেরাও পড়েছেন একই সংকটে।

আগে লিরাকে ডলারে রুপান্তরিত করতে প্রতি ১০০ শত ডলারে ১ ডলার লাগতো। এখন সেখানে ১৫ থেকে ২০ ডলার বেশি দিয়েও ডলার পাচ্ছেন না প্রবাসীরা। এর চেয়ে বড় বিষয় বাজারে ডলারই পাওয়া যাচ্ছে না এবং মানি ট্রান্সফার কোম্পানিগুলো এখন লিরাও নিচ্ছে না।

ফলে প্রবাসীরা ডলার সংকটে দেশে পরিবারের নিকট সময়মত টাকা পাঠাতে না পেরে অস্থিরতায় দিন কাটাচ্ছে। সাইদার মামুনের মতো যারা অল্প বেতনে কাজ করেন তারা পড়েছেন বেশি বিপাকে।

আর তাই শাখাটি সবার জন্য আশা আলো হয়ে দেখা দিয়েছে। খবর পেয়ে লেবাননের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন প্রবাসীরা। দেশে টাকা পাঠিয়ে মামুনের মতােই আত্মতৃপ্তিতে কর্মস্থলে ফিরছেন।

ওয়েষ্টার্ন ইউনিয়নের তাইয়ুনি শাখায়  প্রবাসী বাংলাদেশি
ওয়েষ্টার্ন ইউনিয়নের তাইয়ুনি শাখায় প্রবাসী বাংলাদেশি

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের তাইয়ুনি শাখাটিতে ১ লাখ ৫২ হাজার লিরায় ১০০ ডলার দেশে পাঠাতে পারছেন প্রবাসীরা। আগের চেয়ে সামান্য কিছু বেশি হলেও বর্তমান ডলার সংকট আর আকাশচুম্বী মূল্যের তুলনায় তা সহনীয় বলে জানান প্রবাসীরা।

শাখাটির সহকারি জেনারেল ম্যানেজার মো. এম ফাররান আকাশযাত্রাক বলেন,’বেশ কিছুদিন ধরে এখানে প্রচুর সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের প্রবাসীরাও ভিড় করছে। প্রবাসীদের স্বার্থে আমরা এই শাখাটি সাপ্তাহিক বন্ধের দিন সহ ২৪ ঘন্টা খোলা রেখে তাদেরকে স্বল্প খরচে দেশে টাকা পাঠানোর সুযোগ করে দিচ্ছি।’

তবে এই সুযােগ থেকে বরাবরের মতোই বঞ্চিত থাকছেন লেবাননে অবৈধ প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আইন অনুযায়ী দেশে টাকা পাঠাতে ইকামা প্রয়োজন। ইকামা না দেখে কোন ব্যাংক বা মানি ট্রান্সফার কোম্পানী কোন প্রবাসীর টাকা তার দেশে পাঠাবে না।

তাইয়ুনির ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে দেশে টাকা পাঠাতে আসা অবৈধ প্রবাসী বেলাল বলেন,’আমি এ দেশে অবৈধ, আমার ইকামা নেই। ইকামা ছাড়া এখান থেকে দেশে টাকা পাঠানো যায় না। তাই আমার পরিবারের সমস্যা থাকা সত্বেও আমি দেশে টাকা পাঠাতে পারছি না।’

আগের খবর:
লেবাননে ডলার সংকটে চরম দূর্ভোগে প্রবাসী বাংলাদেশিরা
লেবাননের বাইরে একসাথে বেশি ডলার পাঠাতে নিষেধাজ্ঞা!
লেবাননে ডলার সংকটে চরম দূর্ভোগে প্রবাসী বাংলাদেশিরা (ভিডিও)

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!