মৃত্যুপথযাত্রী প্রবাসীকে দেশে পাঠিয়ে শেষ ইচ্ছা পুরণ করল সিঙ্গাপুরিয়ানরা

শিকদার রানা (৩৪)। সিঙ্গাপুরপ্রবাসী বাংলাদেশি রেমিট্যান্সযোদ্ধা। কাজ করেন সেখানকার একটি শিপইয়ার্ডে। বেশ ভাল চলছিল সবকিছু। কিন্তু গত মাসে সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে হঠাৎ করে ধরা পরে শিকাদার রানা পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত,অবস্থা গুরুতর পর্যায়ে, বেশি দিন বেঁচে থাকার আর সম্ভাবনা নেই।

মৃত্যু আসন্ন জেনে শিকদারের ইচ্ছে জাগে জীবনের শেষ ঈদটি দেশে করার, ব্যাকুল হয়ে পড়েন দেশে থাকা তার ছয় বছরের সন্তানকে শেষবারের মত দেখতে, বুকে জড়িয়ে নিতে। মায়ের হাতের রান্না শেষবার খেতে।

তার শেষ ইচ্ছা পুরনে গত ১৯ মে বন্দোবস্ত করা হয় দেশে ফেরার। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে ১৪ মে লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ। এতে করে সব ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায়, ভণ্ডুল হয়ে যায় সিকদারের দেশে ফেরার সব আয়োজন।

Travelion – Mobile

সিঙ্গাপুরের সংবাদমাধ্যম দ্য স্ট্রেট টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ৩০ মে পর্যন্ত লকডাউন বাড়ায় এতদিন নাও বেঁচে থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করেন শিকদারের চিকিৎসকেরা। এমন সময় সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ক্যান্সার সেন্টার সিঙ্গাপুরের সাপোর্টিভ অ্যান্ড প্যালিয়েটিভ ডিভিশনের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. সিনথিয়া গোহ এগিয়ে আসেন। সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পারে শিকদারের শেষ ইচ্ছার কথা।

এরপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে মেডিকেল এভাক্যুয়েশন ফ্লাইট বা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের জন্য খরচ হবে প্রায় ৫৫ হাজার ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৭ লাখ টাকা। অন্যদিকে আগামী মাসের আগে কোন বাণিজ্যিক ফ্লাইটও নেই। এদিকে শিকদারের হাতেও সময় নেই। দিন দিন তার অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে উঠছে। তার শেষ ইচ্ছা পূরণে তাকে শিগগিরই দেশে পাঠাতে হবে।

স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে শিকদার রানা
স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে শিকদার রানা

স্ট্রেট টাইমসকে ডা. সিনথিয়া গোহ বলেন, তিনি (শিকদার) হতাশ হয়ে পড়েছিলেন… এমনকি যখন জানতে পারলেন তার আর চিকিৎসা নেই তখন স্বেচ্ছামৃত্যুর কথাও বলেছিলেন। তবে সন্তানকে দেখায় মনোবাসনাই তাকে টিকিয়ে রাখে।

ডা. সিনথিয়া গোহ আরও বলেন, লকডাউন তুলে দেওয়া পর্যন্ত হয়তো তিনি বেঁচে থাকবেন না। তাই আমরা তাকে কিভাবে দ্রুত বাড়ি পাঠাতে পারি সেই চেষ্টা করছিলাম।

এরপরই সহযোগিতার খোঁজে বের হলে গত বৃহস্পতিবার ডা. সিনথিয়াকে মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স সেন্টারে (এমডব্লিউসি) পাঠানো হয়। এটি দেশটির জনশক্তি মন্ত্রণালয় ও ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস অ্যান্ড এমপ্লয়ার্স সমর্থিত অভিবাসী শ্রমিকদের একটি কল্যাণমূলক সংস্থা।

এসময় এমডব্লিউসি দু’টি পথ বের করে- ডোনেশনের জন্য আবেদন করা এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সোশ্যাল সার্ভিসের প্রেসিডেন্ট আনিতা ফ্যাম ও এমডব্লিউসি’র চেয়ারম্যান ইয়ো গুয়াত কোয়াং তাদের ব্যক্তিগত ক্ষমতায় এভাক্যুয়েশনের খরচ দেয়া। এর ভিত্তিতে রানাকে দেশা ফেরাতে গত শুক্রবার একটি গ্যারান্টি লেটারের অনুমোদন দেয় মেডিকেল এভাক্যুয়েশন কোম্পানি হোপ মেডফ্লাইট এশিয়া।

সেইসঙ্গে এয়ারক্রাফট চার্টার্স ইউনিয়নের মাধ্যমে ফ্লাইট খরচে কিছুটা ছাড়ও আদায় করে নেয় এমডব্লিউসি। হোপ মেডফ্লাইট এশিয়া তাদের বিল নামিয়ে আনে ৪৮ হাজার ডলারে।

এছাড়া বর্তমানে গিভিং.এসজি নামে একটি ওয়েবসাইটে শিকদারের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা হচ্ছে। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত সেখানে ৬০ হাজার ডলার জমা হয়, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫১ লাখ টাকা। এখান থেকে শিকদারের ফ্লাইট খরচ মিটিয়ে বাকি অর্থ দেওয়া হবেতার পরিবারকে।

অবশেষে সিঙ্গাপুরিয়ানদের অশেষ মহানুভবতায় মৃত্যুপথযাত্রী শিকদার রানার শেষ ইচ্ছা পূরণ হল। গত শুক্রবার এয়ার অ্যাম্বুলেন্স দেশে ফিরেন তিনি। পরিবারের মা, স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে পালন করেছেন ঈদ। খেয়েছেন মায়ের হাতের রান্না করা সেমাই, খিচুড়ি।

স্ট্রেইট টাইমসকে শিকদার বলেন, এটি আমার সম্ভবত শেষ ঈদ। দীর্ঘসময় পর আমি আমার মায়ের হাতের খাবারের স্বাদ নিতে পারলাম। মনে হচ্ছে, বেহেশতে আছি।

তিনি আরও বলেন, আমি জানি না আমাকে কতজন সাহায্য করেছেন কিন্তু সবাইকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই। তাদের কারণে আমি আমার সন্তানের সঙ্গে এবং এ কারণে এখন শান্তিতে মরতে পারব।

বাংলাদেশি একজন সাধারণ প্রবাসী কর্মীর জন্য সিঙ্গাপুরিয়ানদের তাদের এমন মানবিক দৃষ্টান্ত চারিদিকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!