মর্গে পড়ে থাকে প্রবাসীর লাশ, ফিরে চাঁদার টাকায়
সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী মনোয়ার হোসেন (৪৩)। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ফকির আহাম্মদের ছেলে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি মনোয়ার মারা গেলেও দীর্ঘ ১৬ দিন দেশটির আল আইন জিমি হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকে তার লাশ। বৃহস্পতিবার রাতে দেশে পাঠানো তার লাশ, প্রবাসীদের চাঁদায়!
মনোয়ারের মতো গত সপ্তাহে আবুধাবিপ্রবাসী মৌলভীবাজারের রিয়াজুল ইসলাম রাজন (৩৩) ও একই জেলার সাইদুর রহমান (২০) এর মরদেহও দেশে পাঠানো হয়েছিল প্রবাসীদের চাঁদার টাকায়। দুই মাস মর্গে পড়ে থাকে রাজনের মরদেহ, আর সাইদুলের মরদেহ ৮ দিন।
আমিরাতে মনোয়ারের ভিসার বৈধতা নেই মর্মে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাশ দেশে পাঠাতে সাহায্য প্রার্থনা করে তার স্বজনরা। যা দেখে এগিয়ে আসেন একই উপজেলার সাইফুল ইসলাম। চাঁদা উত্তোলন করে টিকিটের টাকা জোগাড় হলে তবেই ইত্তেহাদ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বৃহস্পতিবার রাতে দেশের উদ্দেশে পাঠানো হয় মনোয়ারের লাশ।
অন্যদিকে রাজন ও সাইদুরেরও ভিসার বৈধতা না থাকায় ভাগ্যাহত এই দু’জনের ক্ষেত্রেও লাশ পাঠানো নিয়ে একই জটিলতা দেখা দেয়। এদের লাশ দেশে পাঠানোর দায়িত্ব নেন আল আইনের ব্যবসায়ী শেখ ফরিদ সিআইপি । গত একবছর এমন আরো ১২ জনের মরদেহ দেশে পাঠিয়েছেন সিআইপি শেখ ফরিদ। একই কায়দায় এনআরবি সিআইপি এসোসিয়েশন গত একবছরে আরো ১৫ জন প্রবাসীর লাশ দেশে পাঠিয়ে। এরমধ্যে ওমান থেকে ১০ জন, আরব আমিরাত থেকে ৩ জন ও কাতার থেকে ২ জনের লাশ রয়েছে।
জানা গেছে, প্রতিবছর বিভিন্নভাবে গড়ে প্রায় ১ হাজার বাংলাদেশি মারা যান সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বিমান ভাড়া ও যাবতীয় খরচ মিলে একজন প্রবাসীর লাশ দেশে পাঠাতে খরচ হয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। প্রবাসে মৃত্যুবরণ করা বৈধ ভিসাধারীদের ক্ষেত্রে দূতাবাসগুলো সরকারি ফান্ড থেকে সামান্য অর্থ সহযোগিতা দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দূতাবাস বৈধ ভিসাধারীদের লাশ পাঠাতে তাদের কোম্পানি বা স্পন্সরের সহযোগিতা নেয়। কিন্তু অবৈধ প্রবাসীরা পান না নূন্যতম সেই সরকারি সহযোগিতা। কোম্পানি বা স্পন্সর না থাকায় লাশ প্রেরণেও তৈরি হয় নানা জটিলতা। সুবিধাবঞ্চিত প্রবাসীর লাশ প্রেরণের টাকা জোগাড় করতে আত্মীয়-পরিজনদের ঘুরতে হয় দ্বারে দ্বারে। এক পর্যায়ে তাদের মৃতদেহ দেশে পৌঁছায় প্রবাসীদের উত্তোলিত চাঁদার টাকায়।
আবুধাবি প্রবাসী ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘প্রবাসীরা দেশের জন্যই আমৃত্যু খেটে যান। তারা মারা গেলে চাঁদা তুলে লাশ দেশে পাঠানো অত্যন্ত বেদনাদায়ক ব্যাপার। এভাবে চাঁদা তুলে লাশ পাঠানো সম্মানজনক নয়। সরকারের উচিত এই বিষয়টি বিশেষ নজর দেওয়া।’
সিআইপি এসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য শেখ ফরিদ বলেন, ব্যক্তিগত ও সমষ্ঠিগতভাবে আমরা লাশ দেশে প্রেরণের জন্য সহযোগিতা করছি। সিআইপি এসোসিয়েশনও ১৫ প্রবাসীর লাশ পাঠিয়েছে। বৈধ প্রবাসীরা সরকারি সহযোগিতা পান কিন্তু সরকারের উচিত বৈধ কিংবা অবৈধ সকল প্রবাসীর লাশ সরকারি খরচে দেশে নিয়ে যাওয়া। কারণ সারাজীবন এরা দেশের জন্যই রেমিট্যান্স পাঠান।’
গত একবছরে কী পরিমাণ প্রবাসীর লাশ দেশে প্রেরণে সরকারি সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে এমন তথ্য জানতে দুবাইস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের ডেপুটি কনসাল জেনারেল মো. সাহেদুল ইসলাম ও প্রথম সচিব শ্রম ফকির মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
বেঁচে থাকলে তারা রেমিট্যান্সযোদ্ধা, অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখার কারিগর। কিন্তু মারা গেলে এরাই হয়ে যান সর্বোচ্চ অবহেলার পাত্র। দেশে পাঠানোর অর্থাভাবে প্রবাসীর লাশ মর্গে পড়ে থাকে মাসের পর মাস, এটাই চরম বাস্তবতা।