ব্রুনাইয়ে মানব পাচারের মূল হোতা মেহেদী আত্মগোপনে

ব্রুনেইয়ে মানব পাচার চক্রের অন্যতম হোতা শেখ আমিনুর রহমান হিমুকে তাঁর দুই সহযোগী নুর আমিন ও বাবুল রহমানকে গত বুধবার রাজধানীর কাফরুল এলাকা থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে র‍্যাব-৩-এর একটি দল। এ নিয়ে এই চক্রের ৯ জনকে গ্রেপ্তার হলেও এই চক্রের প্রধান নেতা মেহেদী হাসান ওরফে বিজনকে (২৮) এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। মেহেদী হাসান ও তাঁর অন্য সহযোগীরা দেশে গা ঢাকা দিয়েছেন বলে পুলিশের ভাষ্য ।

ব্রুনাইয়ে মানবপাচারের ঘটনায় অসংখ্য ভুক্তভোগী র‍্যাব-৩ এ করা অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, ব্রুনাইয়ে মানব পাচারের মূল হোতা মেহেদী হাসান বিজন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন অপুর অন্যতম সহযোগী গ্রেফতার শেখ আমিনুর রহমান হিমু। তিনি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান করেন এবং মেহেদী হাসান বিজনের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক। বিজনের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ব্রুনাই মানবপাচার করতেন গ্রেফতার হিমু।

মেহেদী হাসানের বাড়ি মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার যতারপুরে। বাবা মোস্তাকিন হাসান পেশায় কৃষক। তাঁর ১০-১১ বিঘা জমি আছে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় মেহেদী। ৯ বছর আগে পিকআপ ড্রাইভার হিসেবে বেতন ৪০০ ডলার বেতনে ব্রুনেইয়ে যান মেহেদী হাসান।

Travelion – Mobile

মেহেদী ব্রুনেইয়ের এক নারীর সঙ্গে যৌথভাবে, কখনো এককভাবে একাধিক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার মানুষ পাচার করেন। সর্বশেষ ৪ শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে ৩ কোটি টাকা নিয়ে মাত্র ৬০ জনকে ব্রুনেইয়ে নিয়ে যায় মেহেদী। কিন্তু তাঁদের কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। ব্রুনেইয়ের রাস্তায় তাঁদের দিন কাটতে থাকে। পরে করোনা মহামারির সময় দেশে নিজ পরিবারের আর্থিক সহযোগিতায় গত জানুয়ারিতে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তাঁরা ব্রুনেইয়ে অবস্থানরত মেহেদী হাসানসহ তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মানব পাচার ও প্রতারণার আইনে মামলা করেন।

বিদেশের মাটিতে ভিসা ব্যবসা, মানবপাচার, শ্রমিকদের চোরাচালান কাজে ব্যবহার, বেতন ও খেতে না দেওয়া, কাজ না দেওয়াসহ রাষ্ট্রবিরোধী অব্যাহত কার্যক্রমের সুনির্দিষ্ট কারণে ব্রুনাইয়ে সক্রিয় ভিসা দালাল চক্রের মূল হোতা মেহেদী হাসান বিজনসহ সাত জনের পাসপোর্ট বাতিলের বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায়। পরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পাসপোর্ট অধিদফতর মেহেদী হাসান বিজনসহ সাত জনের পাসপোর্ট বাতিল করে।

পাসপোর্ট বাতিলের পর করোনা সংক্রমণের আগে গত ফেব্রুয়ারিতে মেহেদী হাসানসহ পাঁচজন দেশে ফেরত আসেন। দুজন মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। এখন পর্যন্ত এই চক্রের ছয়জন ধরা পড়েছে। মেহেদীসহ পলাতক বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে পুলিশ জানিয়েছে।

আত্মগোপনে থাকা মেহেদী হাসান বিজনের নামে দেশে ২০টি মামলা হয়েছে এবং বর্তমানে তিনি বাংলাদেশে আছেন। জানা গেছে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরিচয় ও তাদের সাথে তোলা ছবি দেখিয়ে এবং প্রভাব খাটিয়ে আরো ডজন খানেক মামলা দায়ের করা থেকে মেহেদীর তার ভুক্তভোগী শ্রমিকদের নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেন।

এক বছর আগে মেহেদী হাসান গ্রামের বাড়িতে ৮ কামরা বিশিষ্ট একটি বিলাসবহুল দ্বিতল ভবন করেছেন,যেখানে ঠাই পেয়েছে বিশ্বমানের ফার্নিচার এবং শোপিস। পাশেই নির্মাণ করছেন ১৫ কামরা বিশিষ্ট একটি তিনতলার বিল্ডিং। ব্রুনাইতে তিনি হাল ফ্যাশনের একটি জাগুয়ার স্পোর্টস জিপ ব্যবহার করতেন, যারা বাজার দর প্রায় ৪ কোটি টাকা।

মামলার ছায়া তদন্তের সঙ্গে যুক্ত র‍্যাব-৩-এর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মেহেদী হাসান বা তাঁর সহযোগীদের নামে বাংলাদেশে কোনো রিক্রুটিং লাইসেন্স নেই। তাঁরা রাজধানীর নয়াপল্টনের হাইওয়ে ইন্টারন্যাশনাল ও কিশোরগঞ্জের নজরুল ইন্টারন্যাশনালে সার্ভিসের মাধ্যমে ব্রুনেইয়ে লোক পাঠিয়ে প্রতারণা করতেন বা পাঠানোর কথা বলে টাকা নিতেন। মানব পাচারে সহায়তা করার অভিযোগে হাইওয়ে ইন্টারন্যাশনালের মালিক মোহাম্মদ আবুল কালাম এবং নজরুল ইন্টারন্যাশনালের মালিক নজরুল ইসলামকেও খুঁজছে র‍্যাব।

ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে সিআইডি কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ব্রুনেইয়ে থাকার সময় মেহেদী বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন। তিনি সেখানে বুলেটপ্রুফ হামার এইচ-২ গাড়ি চালাতেন। সেই গাড়ির নম্বরও ছিল মেহেদীর সেখানকার মুঠোফোন নম্বরের সঙ্গে মেলানো।

সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, মেহেদী হাসানের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশের হাইকমিশনার গত ৩ জানুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দেন। সেটি আসে সিআইডির হাতে। পরে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে মেহেদীর সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বলেন, গ্রেপ্তারের খবর শুনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত মানুষ আসতে থাকেন। সবারই অভিযোগ, কাজ দেওয়ার নামে বিদেশে নিয়ে প্রতারণা করেছে এই চক্র।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!