ব্রুনাইয়ে মানবপাচারের হোতা হিমুর প্রতারণার শিকার ৪০০ তরুণ

কখনো এমপির পরিচয়, কখনো রিক্রুটিং এজেন্সি পরিচয়ে তরুণদের ব্রুনাইয়ে ভালো চাকরির টোপ ফেলতেন। প্রবাসে সচ্ছল জীবনের আশায় টাকা তুলে দিতেন হিমুর হাতে। কেউ তিন লাখে কেউ চার লাখ টাকা, পৌঁছেও যান স্বপ্নের প্রবাস ব্রুনাইয়ে। কিন্তু গিয়ে জানতে পারেন তাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। শেষ পর্যন্ত দুই বছরের কষ্ঠময় জীবন কাটিয়ে ভিসার মেয়াদ শেষে সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে দেশে। আর অপকর্মে নায়ক আমিনুর রহমান হিমু হয়েছে কোটিপতি। প্রায় চারশ তরুণের সঙ্গে প্রতারণা করে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে হিমু।

কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অবশেষে ধরা পড়লো র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র‌্যাব) হাতে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগে ব্রুনাইয়ে মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা শেখ আমিনুর রহমান হিমুসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে এনএসআই ও র‌্যাব। বুধবার দুপুরে রাজধানীর কাফরুলে অভিযান চালিয়ে প্রথমে হিমুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার কাছে পাওয়া যায় একটি লাইসেন্স করা বিদেশি পিস্তল ও দুটি ম্যাগজিন। পরে মহাখালীর ডিওএইচ থেকে তার দুই সহযোগী নূর আলম ও বাবলুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে র‍্যাব-৩-এর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমকে র‍্যাব-৩-এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাকিবুল হাসান আমিনুর রহমান হিমুর মানবপাচার ও প্রতারণার বিস্তারিত তুলে ধরেন।

Travelion – Mobile

তিনি জানান, ২০১৯ সালে হিমু ব্রুনাইয়ে মানবপাচারের মূল হোতা মেহেদী হাসান বিজনের কোম্পানির নামে ভুয়া ডিমান্ড লেটার সংগ্রহ করে ৬০ জনকে ব্রুনাইয়ে পাঠান। তারা ঋণ করে ও জমিজমা বিক্রি করে ব্রুনাইয়ে গিয়ে কোনো কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন, পরে নিজ খরচে দেশে ফিরে আসেন। হিমুর নিজের কোনো রিক্রুটিং লাইসেন্স নেই, তিনি নজরুল ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস ও হাইওয়ে ইন্টারন্যাশনাল আরএল ব্যবহার করে ব্রুনাইয়ে মানবপাচার করেন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা জাতীয় প্রেস ক্লাবে মানববন্ধন করার পর র‍্যাবের নজরে আসে বিষয়টি।

ব্রুনাইয়ে মানবপাচারের ঘটনায় অসংখ্য ভুক্তভোগী র‍্যাব-৩ কার্যালয়ে অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, ব্রুনাইয়ে মানব পাচারের মূল হোতা মেহেদী হাসান বিজন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন অপুর অন্যতম সহযোগী গ্রেফতার শেখ আমিনুর রহমান হিমু। তিনি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান করেন এবং মেহেদী হাসান বিজনের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক। মেহেদী হাসান বিজনের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ব্রুনাই মানবপাচার করতেন গ্রেফতার হিমু।

গ্রেফতার হিমু স্থানীয় সংসদ সদস্য পরিচয় দিতেন। এই পরিচয়ে তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেকার তরুণদের টার্গেট করে ব্রুনাইয়ে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখাতেন। ব্রুনাইয়ের চাকরির কথা বলে একেকজনের কাছ থেকে তিন থেকে চার লাখ টাকা নিতেন। কিন্তু ব্রুনাইয়ে কোনো চাকরি না পেয়ে উল্টো জেল খেটে মানবেতর জীবনযাপন করেন প্রবাসীরা। কারণ হিমু ব্রুনাইয়ের যেসব কোম্পানির কথা বলে মানব পাচার করতেন, তাদের কোনো খোঁজই মেলেনি।

ব্রুনাইয়ে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক অবস্থান করছেন। এসব শ্রমিকদের একটি বড় অংশ মানবপাচারকারী চক্রের মাধ্যমে ব্রুনাই গিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশি মালিকানায় প্রায় তিন হাজার কোম্পানি নিবন্ধিত আছে, যার অধিকাংশই নামসর্বস্ব। এসব কোম্পানি ভুয়া বানোয়াট প্রকল্প দেখিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ব্রুনাই থেকে কর্মসংস্থান ভিসা নিয়ে তা দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিক্রি করে। ব্রুনাইয়ে যাওয়ার জন্য এক লাখ ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা থাকলেও আগ্রহীদের কাছ থেকে ৩-৪ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়।

আইন অনুযায়ী ব্রুনাইয়ে একজন কর্মী সর্বোচ্চ দুই বছর অবস্থান করতে পারেন। দুই বছরে অভিবাসন ব্যয়ের টাকা তুলতে না পেরে ভিসার মেয়াদ অতিক্রান্ত করে বাংলাদেশে ফিরে না গিয়ে মানবপাচার চক্রের মাধ্যমে দুই হাজার ব্রুনাই ডলার দিয়ে পার্শ্ববর্তী সারওয়াক প্রদেশ হয়ে মালেশিয়ার পাচার হয়ে যাচ্ছে।

মালেশিয়াতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নামে বর্তমানে কোনো ভিসা দেওয়া হয় না। মূলত ব্রুনাই বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানবপাচার কার্যক্রমের রুট ও গন্তব্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রিক্রুটিং এজেন্ট, বাংলাদেশি দালাল মিলে একটি সংঘবদ্ধ চক্র হয়ে কাজ করছে। এদের উদ্দেশ্য হলো শ্রমিকদের কাছ থেকে মাসিক সুবিধা আদায় করা, শারীরিক নির্যাতন করা এবং তাদের বেকার রেখে দেশে ফেরত যেতে বাধ্য করা, যেন তাদের ওয়ার্ক ভিসার বিপরীতে এভাবে আরও কর্মী আনতে পারে।

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা ও নির্যাতনসহ বহুমুখী অপরাধ প্রবণতার কারণে ব্রুনাইয়ে সক্রিয় ভিসা দালাল চক্রের মূল হোতা মেহেদী হাসান বিজনসহ সাত জনের পাসপোর্ট বাতিলের বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায়। পরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পাসপোর্ট অধিদফতর মেহেদী হাসান বিজনসহ সাত জনের পাসপোর্ট বাতিল করে। মেহেদী হাসান বিজনের নামে দেশে ২০টি মামলা হয়েছে এবং বর্তমানে তিনি বাংলাদেশে আত্মগোপনে আছেন।

মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে প্রভাবশালী কেউ জড়িত কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে র‍্যাব কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত চলছে, প্রমাণ পেলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!