বৈধপথে প্রবাসে গিয়েও সইতে হয়েছে নির্মমতা, হয়েছেন নিঃস্ব

কিশোরগঞ্জের মো. সজল মিয়া। দালালের কথায় বিশ্বাস করে মাসিক ৫২ হাজার টাকা বেতনে চাকরির আশায় ভিটে বন্ধক, ব্যাংক ঋণ এবং ধারদেনা করে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা জোগাড় করে বৈধভাবে গিয়েছিলেন কিরগিজস্তানে। কিন্তু সেখানে মাসজুড়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে বেতন পান ১০ হাজার ৩০০ টাকা। তা থেকে আবার সাত হাজার টাকা কেটে রাখেন নিয়োগকর্তা। জানান, দালাল তাঁদেরকে বিক্রি করে দিয়েছে। পরে দেশ থেকে জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে নিয়োগকর্তা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আছেন তিনি। দেশে ফেরার পরেও রেহাই পাননি তিনি। এখন দালালের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

শুধু সজল মিয়া নয়, সরকার অনুমোদিতভাবে বৈধপথে কিরগিজস্তানে গিয়ে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হওয়া সাত বাংলাদেশি কর্মী দেশে ফিরেছেন। এদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের আমির হামজা, কুমিল্লার মোহাম্মদ অলিউল্লাহ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেহেদী হাসানের সঙ্গে একই ধরনের প্রতারণার শিকার হয়ে দুবাইফেরত ঝিনাইদহের মো. রুবেল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে শোনান তাঁদের ভোগান্তির করুণ কাহিনি।

মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) এবং রাইটস যশোর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন তারা।

Travelion – Mobile

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, কিরগিজস্তানে পাচারকারী চক্রের হাতে এখনো বন্দী আছেন কুমিল্লার শরিফুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, আবু মুসা, জাহাঙ্গীর আলম, নরসিংদীর শামসুল ইসলাম এবং যশোরের নুরুজ্জামান।

সংবাদ সম্মেলনে কান্না জড়িতকন্ঠে নারায়ণগঞ্জের আমির হামজা বলেন, ‘আমাদের বাঁচান। আড়াই মাস বয়সী বাচ্চার খাবার কেনার টাকাও নাই। দালালের হুমকি তো আছেই। এখন আমরা কী করমু?’

মায়ের কানের দুল, তিনটি গরু বিক্রিএবং র নানা মাধ্যমে টাকা জোগাড় করে কিরগিজস্তানে গিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেহেদী হাসান। সেখানে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। মেহেদী বলেন,‘৫২ হাজার টাকার জায়গায় ১০ হাজার টাকা বেতন দেইখ্যা আমি আকাশ থেইক্যা মাটিত পইড়া গেছি। সেই টাকা থেইক্যাও আবার মালিক টাকা কাইট্যা নেয়। বিদেশ গেছিলাম, আর এখন ফকিরের চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছি। ফকির মানুষের কাছে টাকা চাইতে পারে, আমি তা–ও পারি না।’

বেতনের টাকা দিতে না চাইলে কিরগিজস্তানি নিয়োগকর্তা নির্মম আচরণ করতেন বলে উল্লেখ করে মেহেদী হাসান বলেন, ‘একদিন ঘোড়ার চাবুক দিয়া একজনরে মাইর শুরু করে। তারে বলছি, তুই আমার বাপ, মারিস না, তা–ও কথা শুনে নাই।’

কুমিল্লার অলিউল্লাহ পাসপোর্ট উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ থেকে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে ওই দেশের নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। দেশে ফেরার খরচসহ তাঁর খরচ হয়েছে চার লাখ টাকা। ঋণের টাকার জন্য প্রতি মাসে কিস্তি পরিশোধের তাগিদ দিচ্ছেন পাওনাদারেরা, তা নিয়ে খুব বিপদে আছেন তিনি।’

সংবাদ সম্মেলনে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) এবং রাইটস যশোরের কর্মকর্তারা।
সংবাদ সম্মেলনে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) এবং রাইটস যশোরের কর্মকর্তারা।

কিরগিজস্তানের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, কিরগিজস্তানে যাওয়ার আগে দালাল বলেছিল, সুইয়ের মধ্যে সুতা লাগাতে পারলে আর একটু সেলাই করতে পারলেই মাসে ৫২ হাজার টাকা পাওয়া যাবে। অথচ সেখানে কত কাপড় সেলাই হচ্ছে, সে হিসেবে বেতন দেওয়া হতো। বাংলাদেশে যে জিনিসের দাম ৩০ টাকা, সেখানে তা কিনতে হতো ২০০ টাকায়।

‘কিরগিজস্তান বরফের দেশ। একসময় মনে হয়েছে, এখানে মরে গেলে বরফের নিচে লাশ রেখে এলে কেউ খোঁজও পাবে না’, যোগ করেন অলিউল্লাহ।

দুবাইফেরত রুবেল ইসলাম জানালেন,সেখানে যাওয়া, পাঁচ মাসের থাকা–খাওয়া, দেশে ফেরা—সব মিলে খরচ হয়েছে ছয় লাখ টাকা। কিন্তু কোনো কাজ পাননি তিনি।

রুবেল দেশে ফিরেছেন আউটপাস নিয়ে। পাসপোর্ট, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বিএমইটির স্মার্টকার্ড কিছুই সঙ্গে আনতে পারেননি। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে রিক্রুটিং এজেন্সি এয়ার চ্যানেল ইন্টারন্যাশনালের মালিক ও দালালের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক জানান, এইসব ভুক্তভোগীরা প্রবাস থেকে ভিডিও কলসহ নানা মাধ্যমেযোগাযোগ করে তাঁদের কষ্ঠের কথা জানান। পরে কিরগিজস্তানের একটি মানবাধিকার সংগঠনের সাতজনকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলেও এখনো সেদেশে সাতজন বন্দী আছেন। দুবাইতেও একজন বন্দী আছেন।

তিনি আরও বলেন,এই শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার কথা বললে বিএমইটি নানা টালবাহানা করছে। অথচ এ সংস্থার ক্লিয়ারেন্স নিয়েই শ্রমিকেরা বৈধপথে বিদেশ গিয়েছিলেন। ওই দেশের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ না করে এই শ্রমিকদের পাঠাল কেন?

রামরুর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, এই শ্রমিকেরা দালালের মাধ্যমে গেলেও তাঁরা বৈধ পথে বিদেশ গিয়েছেন। যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছেন তাঁরা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এদের ভোগান্তির পেছনে যে এজেন্সি এবং সরকারি কর্মকর্তারা দায়ী, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দালালদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সূত্র: প্রথম আলো

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!