বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ
বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটছে বাংলাদেশের। টানা তিন বছরের পর্যালোচনা শেষে গতকাল শুক্রবার রাতে জাতিসংঘ দ্বিধাহীনভাবে এই ঘোষণা দিয়েছে। সংস্থাটির কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশকে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে। শুধু তাই নয়, করোনা মহামারীর কারণে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ তিন বছরের প্রস্তুতিমূলক সময়সীমা বাড়িয়ে পাঁচ বছর করার প্রস্তাবও গ্রহণ করেছে জাতিসংঘ। পাঁচ বছরের প্রস্তুতিকালীন সময় শেষে ২০২৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়া হবে বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য আরও যে দেশগুলো চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে তার মধ্যে নেপাল, ভুটান ও লাওসের নাম রয়েছে। এ ছাড়া তালিকায় মিয়ানমারের নাম থাকলেও দেশটি চূড়ান্ত সুপারিশ পায়নি বলে জানা গেছে।
উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৬ পয়েন্টের প্রয়োজন; বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ৭৫.৩। এ ছাড়া অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে কোনো দেশের পয়েন্ট ৩৬ এর বেশি হলে এলডিসি এবং ৩২ এ আসার পর উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন করে। সেখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক২। অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের নানা অভিঘাত মোকাবিলা করে, এমন কি করোনা মহামারীর মাঝেও তিনটি সূচকেই তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি দেখিয়ে উন্নয়নশীলে উত্তরণের সুপারিশ অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি এমন একটি সময়ে এসেছে, যখন স্বাধীনতার ৫০তম বছর অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী পালনের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। পালন করা হচ্ছে এই দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এছাড়া বাংলাদেশের এই অর্জন এমন এক সময় যখন ‘কভিড-১৯’ নামে এক ভয়ানক মারণ ভাইরাসের সংক্রমণে সারা বিশ্ব সংকটে পড়েছে। সেই সংকট মোকাবিলা করে অতীতের মতো আরও একবার উচ্চারিত হলো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার নাম, যখন জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার এই বাংলাকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত করতে কাজ করে যাচ্ছে।
স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৫ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় নাম ওঠে বাংলাদেশের। এর ৪৩ বছর পর ২০১৮ সালে জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া তিনটি সূচকেই নির্ধারিত মান অর্জন করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। এরপর তিন বছর পর্যবেক্ষণকালীন সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলা হয়, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই তিনটি সূচকে মানদন্ড ধরে রাখতে পারলে চূড়ান্ত সুপারিশ করা হবে। এ পর্যায়ে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বা সিডিপির ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভা গত ২২ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে গতকাল রাত পর্যন্ত চলে। ওই সভাতেই দ্বিতীয় দফা পর্যালোচনা শেষে শুক্রবার রাতে জাতিসংঘ সেই কাক্সিক্ষত সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দেয়।
সরকারের সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা মহামারী বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক খাতেও। এ পরিস্থিতিতে আশঙ্কা ছিল, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ সক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে কি না। সেই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে কভিড-১৯ মহামারীর মতো বৈশ্বিক সংকটেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াল বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, মাথাপিছু আয় এবং মানবসম্পদ সূচকে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতির মাধ্যমে জানান দিল, তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দেশগুলোর একটি-বিশ্ব অর্থনীতিতে যাকে ‘ইমার্জিং টাইগার’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আরও উৎসাহিত হবেন। তাদের মধ্যে আস্থা আরও বাড়বে। আন্তর্জাতিক সংস্থা কিংবা আঞ্চলিক জোটগুলোতে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে ভাবমূর্তি উন্নয়নের ফলে বৈদেশিক ঋণ পাওয়া সুবিধাজনক হবে। বহুপক্ষীয় বা দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ক্ষেত্রে আরও বেশি মূল্যায়ন করা হবে বাংলাদেশকে। তবে মর্যাদা বাড়ার কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ঋণের সুদের হারও বাড়বে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ উন্নত দেশগুলোতে বাংলাদেশ যে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা পাচ্ছে সেটি প্রত্যাহার হলে দেশের তৈরি পোশাক খাত কিছুটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে পারে।
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন