প্রবাসে আমায় কবর দিও, চাই না হতে হিমঘরের বাসিন্দা!

মৃত্যু অনিবার্য। এটা চির সত্য ও সর্বজন স্বীকৃত। তুমি যখন জন্মেছো তোমাকে মরতে হবে। শুধু মানুষ নয়, যার ভেতরেই প্রাণ আছে তার জন্য অবধারিত মৃত্যু। ধর্ম মতবাদ দৃষ্টিভঙ্গি যার যাই হোক না কেন, একটি জায়গায় সকলে একমত আর তা হলো নিশ্চিত মৃত্যু। আর যে জিনিস অনিবার্য তাকে ভালবাসাটায় শ্রেয়, তার অঅগে সময়মতাে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ওসিয়ত করাটা আরও উত্তম ।

করোনাকালের বর্তমান বিশ্বে এখন শুধুই মৃত্যুর মিছিল, চারদিকে মৃত্যুর গন্ধ। প্রতিদিনই কানে বাজছে স্বদেশ-প্রবাসের চেনা-অচেনা অনেকের অনিবার্য মৃত্যুকে আলিঙ্গনের খবর। অনিবার্য যখন এ নিয়ে আমার কোন ভয় নেই, আমরা ভাবনাটা মৃত্যু পরবর্তী শেষ বিদায়ের ব্যবস্থাটা নিয়েই।

আমি চাইনা প্রবাসে আমার মৃত্যুর পরে পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে একটি টোকেন পরিয়ে হাসপাতালের মর্গের হিমঘর দেশে পাঠানোর ফ্লাইটের অপেক্ষায় মাসের-পর-মাস হিমায়িত হোক আমার মরদেহ। চাইনা, প্রবাসে আমার মৃত্যুর পর মরদেহ নিয়ে আমার পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হোক।

Travelion – Mobile

তাই দুমাস আগে আমি ফেসবুকে অ্যালান করেছিলাম, বলতে পারেন ওসিয়ত করেছিলাম যে, করোনাকালে আমার মৃত্যু হলে যেন আমার মরদেহটি ওমানের মাটিতে দাফন করা হয়, কারণ আমি ওমানপ্রবাসী বাংলাদেশি। আর সেটা যদি খাসাবের মাটিতে হয় তবে আরও ভাল হয়, কারনে সুলতানাতের এই সুন্দর ভূখণ্ডটির আকাশ-বাতাসে আমার প্রাণ মিশে গেছে।

এটা আমার একটি প্রিভেন্টিভ একশন বা ওসিয়ত। এই ওসিয়তের কথা আমি আমার স্ত্রী, আমার মা এবং প্রবাসে কাছের বন্ধুদের জানিয়েছি। পরিবারের সম্মতি বা সমর্থনও পেয়েছি।

করোনাভাইরাস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। ভাইরাস ছড়ানোর আশংখায় করোনায় মারা যাওয়া মরদেহ স্থানান্তরের কোন সুযোগ কোথাও নেই, সরকারি ব্যবস্থাপনায় দ্রুত সৎকারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

বলছিলাম অন্য নানা রোগে, দুর্ঘটনায় স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা। বর্তমানে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকায় বাংলাদেশিদের মরদেহ জমা হচ্ছে প্রবাসের বিভিন্ন হাসপাতালের হিমঘরে। বিশেষ করে সাধারণ ও কম আয়ের প্রবাসীর মরদেহে পূর্ণ হচ্ছে হিমঘর। বিত্তবান বা সামর্থ্যবানদের অনেকের মরদেহ কার্গো ফ্লাইটে অনেক খরচে পাঠানো হচ্ছে বটে, তাও করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ার ফাঁদে পড়তে হচ্ছে।

পরিবারের সম্মতি না পাওয়ায় সাধারণদের অনেকের মরদেহ প্রবাসীের মাটিতে দাফনও করা যাচ্ছে না। সত্যিই আমি অবাক, কিসের আশায়, কিসের নেশায় দেশের ওই ‘রক্তচোষারা’ স্থানীয়ভাবে মরদেহগুলো দাফনের সম্মতি দিচ্ছে না: মৃত্যুর আগে মরা মুখটি একবার দেখতে চান? দেশে নিয়ে মরদেহ দাফনে সওয়াব বেশি নাকি, বাপ- দাদার পাশে কবর দিয়ে ধন্য হবেন ?

আসলে দেশে প্রবাসীদের ভালোবাসার রক্তচোষারা, লাশের উপর কোন অনুভূতি না থাকলেও সঙ্গে থাকা ব্যাগগুলাের ওপর নজরটা মনে হয় বেশি থাকে!
ব্যাগের মধ্যে কি কি আছে ? কোম্পানি কত টাকা দিয়েছে ? মৃত্যুর পূর্বে ইন্সুরেন্স ছিল কিনা ? প্রবাসী মন্ত্রণালয় থেকে কত টাকা পাওয়া গেছে? বিদেশের ব্যাংকের একাউন্টে কত টাকা ছিল ?

আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে যে প্রথাটি চালু আছে তা হলো, সঙ্গতকারণ ছাড়াই অনর্থক মরদেহ কাফন-দাফন করার ক্ষেত্রে বিলম্ব করা হয়। ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যদি কেউ দেশের বাইরে গিয়ে থাকে, তাহলে তাদের দেশে ফেরা পর্যন্ত মরদেহ দাফন করা হয় না। অনেক সময় দেখা যায় ভিসা জটিলতার কারণে মরদেহ দেশে ফিরতে অনেক দেরি হয়। এতদিন পর্যন্ত মরদেহ কবরস্থ করা হয় না। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনের একটি লিখিত সম্মতিতে প্রবাসেই ইসলামিক রীতিতে মরদেহ দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা যায়, বিশেষ করোনাকালে এই সংকটকালে।

মরদেহ কাফন-দাফনের ক্ষেত্রে এ ধরণের বিলম্ব করার কোন অনুমতি ইসলামে নেই। আর এটা জানার জন্য এখন আর কোন বিজ্ঞ আলেমের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নাই। বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাষায় বিলম্ব করা থেকে নিষেধ করেছেন। অনেক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

আমার মতে এজন্যই প্রবাসীরাই দায়ী। কারণ মৃত্যুর আগে তারা নির্দিষ্টভাবে কোন ওসিয়ত করে যান না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী মুসলমানদের উচিত হবে, মৃত্যুর পূর্বেই আত্মীয়-স্বজনদেরকে ওসিয়ত করা যে, যদি মধ্যপ্রাচ্যে মৃত্যু হয়। অতি দ্রুত যেন আরব দেশেই দাফন কাফনের সম্পন্ন করা হয়,যেমনটি আমি ওসিয়ত করলাম।

বাংলাদেশ নিয়ে দাফন করার চাইতে, আরবদেশে দাফন করা কি বেশি উত্তম নয়? আল্লাহ তা’আলা আমাদের প্রবাসীদেরকে সঠিক বুঝ দান করবেন আশা করি।

লেখক: ওমানপ্রবাসী বাংলাদেশি প্রকৌশলী, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট প্রফেশনাল

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!