প্রবাসী বোনের লাশ পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন দুই ভাই

প্রথম আলো প্রতিবেদন

বোনের লাশ পেতে দালাল, রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, কোনো লাভ হয়নি। বিমানবন্দরে লাশ এলে সেটি গ্রহণের জন্য মুঠোফোন নম্বর দিয়ে রেখেছেন। শার্টের পকেটে বোনের একটি ছবিও রেখেছেন। বোন মারা গেছেন ফেব্রুয়ারি মাসে, ভাই এখনো জানেন না তাঁর লাশটি কবে দেশে আসবে। ভাইয়ের আক্ষেপ,‘বোনের লাশ আনার জন্য কত জায়গায় যে দৌড়াইতাছি, কিছুই লাভ হইতেছে না।’

সৌদি আরব থেকে বোনের মরদেহ দেশে আনার জন্য সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে করা আবেদনে এমনটি জানিয়েছেন, এক ভাই আক্কাস মিয়া। জানালেন,৩৩ বছর বয়সী বোনের নাম ফাতেমা আক্তার। গত ৩ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। আর এ খবরটা ভাই আক্কাস মিয়া ও শরিফুল ইসলাম জানতে পেরেছেন প্রায় ১১ দিন পর। স্থানীয় ব্র্যাক অফিসের মাধ্যমে ফাতেমার দুই ভাই মঙ্গলবার ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে বোনের মরদেহ দেশে আনার আবেদন জানিয়েছেন।

আক্কাস মিয়া বললেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসেই আমার বোনের দেশে আসনের কথা ছিল। দালাল কয়, বোন নাকি আত্মহত্যা করছে। যে মানুষটা দেশে আসনের খুশিতে ছিল, সে ক্যান আত্মহত্যা করব?’

Travelion – Mobile

চার ভাই–বোনের মধ্যে ফাতেমাই সবচেয়ে বেশি সুস্থ ছিলেন বলে জানালেন দুই ভাই। বললেন, ঠান্ডা মেজাজের বোনটি আত্মহত্যা করেছে—এটা তাঁরা মানতে পারছেন না।

ফাতেমার ভাই আক্কাস মিয়া ছোটবেলা থেকেই এক চোখে দেখতে না পান না। তিনি কাঁচামালের ব্যবসা করেন। আরেক ভাই শরিফুল ইসলাম দরজির কাজ করেন। লেবাননে ছিলেন ছয় বছর। এখন দুই ভাই তাঁদের কাজ ফেলে একবার সরকারের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, আরেকবার ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, স্থানীয় ব্র্যাকের অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছেন বোনের লাশ দেশে ফেরত আনার জন্য। দুই ভাই বললেন, বৃদ্ধ মা–বাবা বাড়িতে কান্নাকাটি করছেন। বোনের লাশটা দেখাতে পারলেও তাঁরা একটু শান্তি পেতেন।

শরিফুল ইসলাম জানান, ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফোনে ফাতেমার সঙ্গে কথা হয়। তখন ফাতেমা জানিয়েছিলেন, মালিকের কাছে দেশে যাওয়ার টিকিট চেয়েছেন বলে তিনি খুব রাগারাগি করছেন। মালিকের বউ তাঁকে মারতে আসছেন জানিয়ে পরে আবার কথা বলবেন বলে ফোনের লাইন কেটে দিয়েছিলেন।

‘কী হইছে বোন, কান্দো ক্যান—ফোনেই জানতে চাইছিলাম। বোন তাড়াতাড়ি ফোনের লাইন কেটে দেয়। তারপর কতবার রিং হইছে, বোন আর ফোন ধরে নাই’,যোগ করেন শরিফুল ইসলাম।

লেবাননে থাকার সুবাদে শরিফুল আরবি ভাষায় কথা বলতে পারেন। তিনি জানালেন, ফাতেমার মালিকের সঙ্গে আগে কথা বলে তাঁকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন, তখন তিনি খারাপ ব্যবহার করেছিলেন।

ফাতেমা সাভারে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। প্রায় ১০ বছর আগে তাঁর বিয়ে হয়েছিল, তবে কোনো সন্তান হয়নি। তাঁর স্বামী দরজির কাজ করতেন। স্বামী তাঁর গ্রামের বাড়িতে ঋণ করে জমি কিনেছিলেন। এ ঋণ শোধ করার জন্য স্বামী নিজেই ফাতেমাকে বিদেশে পাঠান। ফাতেমা বিদেশ থেকে কয়েক মাস পরপর স্বামীর কাছে ৩০ হাজার, ২০ হাজারের মতো করে টাকা পাঠাতেন। তবে ফাতেমা বিদেশ যাওয়ার পর থেকে স্বামী তাঁর ভাইদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ করতেন না। এমনকি ফাতেমা মারা যাওয়ার পরও তিনি যোগাযোগ করছেন না বলে অভিযোগ করলেন দুই ভাই।

স্থানীয় দালালের কাছে বোনের খবর জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যেতে থাকেন। বোন জীবিত না মৃত—এ খবর জানতে চেয়ে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর মডেল থানায় দালালের নামে সাধারণ ডায়েরিও করেছিলেন দুই ভাই। এরপর গ্রামের মেম্বারসহ মুরব্বিদের নিয়ে দালালের বাড়িতে গেলে চাপের মুখে দালাল বলেন, ফাতেমা মারা গেছেন। সৌদি মালিক টিকিট হাতে নিয়ে ফাতেমাকে ডাকতে গিয়ে দেখেন দরজা বন্ধ। পরে বন্ধ দরজা খুলে ঘরে ঢুকে দেখেন ফাতেমা আত্মহত্যা করেছেন।

দুই ভাই জানালেন, মাস ছয়েক আগেও ভিডিও কলে বোন তাঁর ভাঙা আঙুল দেখিয়ে জানিয়েছিলেন, মালিকের বউ মেরেছেন। খেতে চাইলে খাবার না দেওয়াসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথাও জানিয়েছিলেন ফাতেমা। তাই ফাতেমা আত্মহত্যা করেছেন—এটা তাঁরা মানতে নারাজ।

অপশন ম্যানপাওয়ার সার্ভিস নামের রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ফাতেমা গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। তাঁর দুই ভাই জানালেন, রাজধানীতে এই এজেন্সির অফিস, তাঁরা আজ পর্যন্ত মালিকের চেহারাও দেখেননি। অভ্যর্থনা কক্ষে কথা বলতে হয়, ফাতেমার লাশ দেশে আনার বিষয়ে পরে সব জানাবে বললেও ওই অফিস থেকে আর কিছু জানানো হয়নি। আর দালাল হিসেবে যিনি কাজ করেছেন, তিনি ফাতেমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এর আগে ফাতেমা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, সে কথা জানিয়ে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বললে বা এখন তাঁর লাশ দেশে আনার কথা বললে ওই দালাল খারাপ ব্যবহার করেন। তাঁর ভাষ্যমতে, এটা কি মামার বাড়ির আবদার যে চাইলেও লাশ দেশে এনে দিতে পারবেন তিনি।

দালালের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন কাগজপত্রেও ফাতেমা মারা গেছেন বলে উল্লেখ আছে। সৌদি আরব থেকে আরবিতে পাঠানো প্রাথমিক ফরেনসিক মেডিকেল রিপোর্টটি নিউ আল-মদিনা ট্রান্সলেশন সেন্টার থেকে অনুবাদ করিয়েছেন দুই ভাই। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ফাতেমার ঘাড়ের ওপরের দিক রক্তাক্ত ছিল, সেখানে রক্ত গড়িয়ে যাওয়ার প্রমাণ ছিল। এ ছাড়া তাঁর গায়ে আর কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। অনুবাদ করা প্রতিবেদন বলছে, ফাতেমাকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় নেওয়া হয়েছিল।

জেদ্দার বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের শ্রমকল্যাণ উইংয়ের কাউন্সেলর (শ্রম) মো. আমিনুল ইসলাম গত ৩ মার্চ ফাতেমার মৃতদেহ বাংলাদেশে পাঠানো অথবা স্থানীয়ভাবে দাফনের জন্য উত্তরাধিকারীদের মতামত জানতে চেয়ে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক বরাবর একটি চিঠি দিয়েছিলেন। তাতে থানা ও হাসপাতাল সূত্রের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ফাতেমা ৩ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন। এই চিঠিতেই মৃতদেহ শনাক্তকারী ব্যক্তির নাম ও যোগাযোগের নম্বরসহ ওয়ারিশদের মতামত যৌক্তিক সময়ে পাওয়া না গেলে করোনায় সৃষ্ট সংকটে সৌদি কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে লাশ দাফন করবে বলেও জানিয়েছিল।

ফাতেমার ভাই শরিফুল ইসলাম জানালেন, তাঁরা বোনের লাশ আনার জন্য প্রথমে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে আবেদন করেছিলেন। সেখান থেকে কোনো উত্তর পাননি। পরে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করলেন। এর আগে এখান থেকে তাঁদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেননি।

প্রতিবেদন : মানসুরা হোসাইন, প্রথম আলো

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!