প্রবাসীর মাসহ তিন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে হত্যায় স্ত্রী গ্রেপ্তার

বরিশালের বানারীপাড়ায় চাঞ্চল্যকর থ্রিপল মাডার ঘটনায় কুয়েতপ্রবাসীর মা ও ভগ্নিপতিসহ তিনজনকে হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

রোববার (৮ ডিসেম্বর) রাতে প্রবাসীর স্ত্রী মিসকাত জাহান মিশুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বানারীপাড়া থানার ওসি শিশির কুমার পাল । ঘাতকদের সহায়তার প্রমাণ পাওয়ায় মিশুকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

শনিবার ভোরে উপজেলার সলিয়াবাকপুর গ্রামের কুয়েতপ্রবাসী হাফেজ আব্দুর রবের বাড়ি থেকে তার বৃদ্ধা মা মরিয়ম বেগম (৭৫), ভগ্নিপতি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শফিকুল আলম সফিকুল আলম (৬০) ও খালাত ভাই ইউসুফ হোসেনের (৩২) লাশ উদ্ধার করা হয়।

Travelion – Mobile

বাড়ির বেলকুনির মেঝে থেকে তার মা ও পাশের রুম থেকে ভগ্নিপতি এবং পেছনের পুকুরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ভাসমান খালাতো ভাইয়ের মরদেহ পাওয়া যায়। পুলিশ তিনজনের মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য বরিশাল শেবাচিম হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। একই দিন আব্দুর রবের ছোট ভাই ঢাকার গুলশান এনআরবি ব্যাংক শাখার কর্মকর্তা সুলতান মাহামুদ বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন।

খবর পেয়ে বরিশালের অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম (বিপিএম বার)সহ পিবিআই ও সিআইডি কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। নিহতদের শরীরে বড় ধরনের কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে প্রত্যেকের নাগ ও কান দিয়ে রক্ত ঝরছিল। হত্যাকারীরা পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করেন পুলিশ।

প্রবাসীর নিহত মা মরিয়ম বেগম (৭৫), ভগ্নিপতি শফিকুল আলম (৬০) ও খালাত ভাই ইউসুফ হোসেন  (৩২)
প্রবাসীর নিহত মা মরিয়ম বেগম (৭৫), ভগ্নিপতি শফিকুল আলম (৬০) ও খালাত ভাই ইউসুফ হোসেন (৩২)

এ সময় তারা ওই ভবনের ভেতর থেকে দরজা-জানালা বন্ধ থাকার কথা জানতে পারেন। । তবে আব্দুর রবের স্ত্রী মিশু ও তার ভাতিজি আছিয়া খাতুন ছাদে যাওয়ার দরজা খোলা পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন। তাদের ধারণা ছাদের পাশেই একটি আম গাছ রয়েছে। দুর্বৃত্বরা ওই আম গাছ থেকে ভবনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে ।

সে সময় প্রবাসীর স্ত্রী মিশরাত জাহান মিশু বলেন, রাতে খাবার খেয়ে দক্ষিণমুখী একতলা বাসার প্রথম সারির পশ্চিম দিকের কক্ষে ননদ মমতাজের স্বামী শফিকুল আলম ঘুমাতে যান। নলছিটির বাসিন্দা শফিকুল দুই দিন হয়েছে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসেছেন। বিপরীত পাশের পূর্ব দিকের কক্ষে ভ্যানচালক দেবর ইউসুফ ছিলেন। পরের দুটি কক্ষের একটিতে তিনি (মিশরাত) তাঁর দুই সন্তান ইশফাত (৯) ও চার বছরের নুরজাহানকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। আরেকটি কক্ষে শাশুড়ি মরিয়ম ও জায়ের মেয়ে আছিয়া আক্তার আফিয়া ছিলেন।

লাশগুলো যখন ঘরের ভেতর থেকে বাইরে নামিয়ে রাখা হচ্ছিল, তখন লাশ দেখার জন্য ওই বাড়ির উঠানে সাধারণ লোকজনের সঙ্গে রাজমিস্ত্রি জাকির হোসেনও এসেছিলেন। ঠিক তখনই প্রবাসীর মেয়ে ইশফাত ঘটনাস্থলে থাকা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বলে, রাতে জাকির তাদের ঘরে এসেছিলেন। তখন প্রবাসীর স্ত্রী ঘটনার সত্যতা স্বীকার করলে, ঘটনাস্থল থেকে জাকিরকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে। এরপর র‌্যাব-৮ এর সহায়তায় জাকিরের সহযোগী জুয়েল হাওলাদারকে গ্রেফতার করা হয়।

ট্রিপল মার্ডারের  মূল হোতা কথিত জিনের বাদশা জাকির হোসেন
ট্রিপল মার্ডারের মূল হোতা কথিত জিনের বাদশা জাকির হোসেন

গ্রেপ্তারে পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে জাকির ও তার তার সহযোগী জুয়েল হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। সে সাথে দাবি করেন ঘটনার রাতে প্রবাসীর স্ত্রী মিশুর সহায়তায় ঘরে প্রবেশের করেছিলেন তারা। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য আসার পরপরই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মিশু ও তার ভাতিজী চাখার সরকারি ফজলুল হক কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী আছিয়া খাতুনকে রবিবার থানায় ডেকে আনা হয়।

তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে অনেকগুরুত্বপূর্ণ তথ্য। মিশু দরজা খোলা রেখে জাকিরকে ঘরে ঢোকার সুযোগ দেওয়ার কথা স্বীকার করেন, তবে হত্যার সঙ্গে কোন ধরনের সম্পৃক্ততা ছিল না বলে দাবি করেন।

জিজ্ঞাসাবাদে মিশু পুলিশকে বলেন, বছরখানেক ধরে রাজমিস্ত্রি জাকির হোসেন ভবন নির্মাণের কাজ করে আসছিলেন। একপর্যায়ে জাকির পরিবারকে জানান, ঘরে জিনের আছর পড়েছে। জিন তাড়াতে হবে। কয়েক দিন ধরেই তিনি জিন তাড়ানোর জন্য রাতে বাসায় আসছিলেন। জাকির বলেছেন রাতে দরজা খুলে রাখতে, যাতে ভালো জিন এসে আছর কেটে ফেলবে। পর পর দুই দিন বাসার দরজা খোলা রাখলেও কেউই ঘরে আসেনি। তাই শুক্রবার সন্ধ্যার পরপরই ঘরের দরজা আটকে ফেলেন। জিন তাড়ানোর বিষয়টি তাঁর প্রবাসী স্বামীও অবগত রয়েছেন। এ ব্যাপারে সম্প্রতি বিদেশ থেকে জাকিরকে টাকাও পাঠিয়েছিলেন।

শুক্রবার রাত ৮টার দিকে জাকির হোসেন বাসায় এসে দরজা খোলার জন্য বলেন। সে অনুযায়ী মিশরাত সামনের দরজা খুলে দেন। মিশরাত ও আফিয়াকে একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে জাকির তাঁদের আপত্তিকর অবস্থার ছবি ধারণ করেন। এতে বাধা দিলে জাকির তাঁদের বলেন, ‘জিন তোমার দুই সন্তানকে মেরে ফেলবে।’ তখন ঘরের মধ্যে লোকজনের ধস্তাধস্তি তাঁরা শুনতে পান। জিনরা ঘরের ভেতর ধস্তাধস্তি করছে বলে জাকির বলেন। ঘরের আলমারি থেকে জাকির স্বর্ণালংকার ও তিনটি মোবাইল ফোন এবং মোবাইলে বিকাশ থেকে টাকা নিয়ে ভোরের দিকে চলে যান।

 কুয়েতপ্রবাসী হাফেজ আব্দুর রবের বাড়িতে উৎসুক জনতার ভিড়

কুয়েতপ্রবাসী হাফেজ আব্দুর রবের বাড়িতে উৎসুক জনতার ভিড়

ভাতিজী আফিয়া বলে, ‘জাকির চলে যাওয়ার পর আমার কক্ষে গিয়ে দেখি দাদি সেখানে নেই। পাশের বেলকনিতে দাদির নিথর দেহ পড়ে আছে। আমি ডাক-চিৎকার দিয়ে সামনের কক্ষে গিয়ে বিছানায় ওপর ফুফার লাশ পড়ে থাকতে দেখি। সামনের কক্ষে চাচা ইউসুফ ঘুমিয়ে ছিলেন, সেখানে তাঁকে পাওয়া যায়নি। বাইরে খুঁজতে গিয়ে দেখি তাঁর লাশ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বাসার পেছনের পুকুর ঘাটে উপুড় করে পড়ে আছে।’

আছিয়া আরো বলে, ‘কক্ষের ভেতর যখন শব্দ হচ্ছিল, তখন ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করেছি। কিন্তু রাজমিস্ত্রি বলেছে, ভেতরে গেলে জিন মেরে ফেলবে। তাই ভয়ে আর যাইনি। এমনকি ঘটনার পর জাকিরের নাম বলিনি।’

এ ঘটনার সময় ঘরের অন্য সদস্যরা টের পেলে জাকির ও তার সহযোগীরা এক এক করে তিনজনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন বলে এ পর্যন্ত তদন্তে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। তবে এর পেছনে অন্য কোন কারণ আছে কিনা তাও খোঁজা হচ্ছে।

আটকের পর জাকিরের কাছ থেকে আপত্তিকর কিছু ছবি এবং রাত সাড়ে ৪টায় প্রবাসীর স্ত্রী মিশুর বিকাশ নম্বর থেকে জাকিরের মুঠোফোনে পাঁচ হাজার টাকা পাঠানোর তথ্যও উদ্ধার করে পুলিশ।

এতে মিশুর ভাষ্যের সত্যতা মিললেও দরজা খোলা রেখে ঘাতকদের ঘরে ঢোকার সুযোগর দেওয়া এবং সেই তথ্য গোপন রাখার অপরাধে মিশুকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেজানান ওসি শিশির কুমার পাল।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!