প্রবাসীদের প্রতি মানসিকতার পরিবর্তন জরুরী
শুধু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নয়, পৃথিবী জুড়ে অভিবাসীরা সবচেয়ে নিগৃহীত জনগোষ্ঠী। নিগৃহীত হলেও অবদান ও অর্জনের দিক দিয়ে তাদের সমানুপাতিক অংশগ্রহণ গগনস্পর্শী।
বাংলাদেশ মোট জনসংখ্যা ষোল কোটির উপাত্ত ও বয়স কাঠামো হিসেবে ২৫ থেকে ৫৪ বছরের মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাত ৩৯.৭৩ শতাংশ মানে প্রায় সাড়ে ৬ কোটির মত, তাদের মধ্যে এই বয়স কাঠামোর প্রায় সোয়া এক কোটি প্রবাসী। প্রতি বছর ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অর্থের উৎস এসব প্রবাসীরা।
এই বড় অঙ্কের প্রায় ৬২.২০ শতাংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে। বাকি ৩৭.৮০ শতাংশ আসে ইউরোপ, আমেরিকা, মালেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, জাপানসহ দূরপ্রাচ্য, পশ্চিমা ও আফ্রিকার দেশের অন্যান্য অঞ্চল ও দেশ থেকে।
মধ্যপ্রাচ্যে আসা অভিবাসীদের অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ; যাদের আবার বেশিরভাগ আসে অদক্ষ, আধা-দক্ষ শ্রমিক হিসেবে। সেসব অদক্ষ, আধা-দক্ষ শ্রমিকদের ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় অর্জিত ঘামার্ত বৈদেশিক মুদ্রায় আমাদের দেশের রিজার্ভ ভোল্টকে শীতল রাখে।
অথচ এই মানুষগুলোই প্রতিনিয়ত সবচেয়ে নিগৃহীত হচ্ছে; সেটা দেশে আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে হোক কিংবা বাংলাদেশের কোন দূতালয়ে হোক। বছরের পর বছর পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকা এসব মানুষের প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্রের সবাইকে আরো মানবিক হতে হবে।
বস্তুত ভাসমান এসব মানুষেরা বেশিরভাগই প্রবাসে ও স্বদেশে অনভিপ্রেত ও অনাহূত। আকাশচুম্বী চাহিদা তাদের নেই; চায় শুধু দূতাবাসে কিংবা বিমানবন্দরে একটু মানবিক ব্যবহার, একটু দয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি। এসব মানুষেরা স্বদেশে ফেরার পথে পরিবার-পরিজনের জন্য নিয়ে আসা বড় বড় লাগেজ বা কার্টুন টেনে হিঁচড়ে স্ক্যানার মেশিনে রাখতে হয়, উঠাতে হয় নিজেদের, যেটা খুবই অমানবিক।
সেটি একজন আন্তর্জাতিক যাত্রী, রেমিটেন্সযোদ্ধাদের জন্য যতই না অমানবিক তার চেয়ে বেশি অনুভূতিশূন্য একজন নারী যাত্রীর ক্ষেত্রে। কর্তৃপক্ষ চাইলে দুই চার জন পোর্টার দিয়ে স্ক্যানার মেশিনে লাগেজ উঠা-নামার কাজটা চালাতে পারে, এতে প্রবাসীরা সম্মানিত বোধ করবে।
অন্যদিকে বিশেষায়িত মহিলা/ ফ্যামিলি কাউন্টার না থাকায় পুরুষের পাশাপাশি মহিলা ও শিশুদের ঘণ্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাটা খুবই দৃষ্টিকটু কিন্তু কর্তৃপক্ষের কোন দৃষ্টিক্ষেপণ হয়নি এখনো।
গত এক দশকে বিদেশ থেকে ২২ হাজার ৬৫১ জনের লাশ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশে এসেছে। এর মধ্যে ১২ হাজার ৫৫৭ জনই কাজ করতেন মধ্যপ্রাচ্যের কোনো-না-কোনো দেশে।
অনিরাপদ কর্ম-পরিবেশ, আর্থিক ঋণ, খাদ্যাভ্যাসসহ মানসিক চাপই বেশিরভাগ প্রবাসীর মৃত্যুর কারণ। মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে ওরা দেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে।
অধিকাংশই মৃত্যুর কারণ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হৃদরোগ, কর্মক্ষেত্র বা সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা ক্যান্সারের মতো জটিল কোন রোগ হলে ভাষাগত কারণে সাধারণ রোগীরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে ইতস্তত বোধ করেন বেশিরভাগ প্রবাসীরা।
সরকার চাইলে মধ্যপ্রাচ্যের দুতাবাসগুলোর অধীনে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়োগ দিতে পারেন এতে সুফল পারে সিংহভাগ প্রবাসীরা। ইদানিং প্রবাসে আত্মহত্যার ও অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে বিভিন্ন ঋণ, চিন্তা, হয়রানী, ঝন্ঝাট, ঝামেলা ও পীড়নের কারণে। এই প্রবণতা রুখতে সরকার চাইলে একজন অনাবাসিক মনস্তত্ত্ববিদ (psychologist) নিয়োগ দেয়াটা কঠিন কিছু নয়।
১ এপ্রিল, ২০১৩ তারিখ থেকে বিদেশে বৈধভাবে গমনকারী মৃত কর্মীর প্রত্যেক পরিবারকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড হতে ৩,০০,০০০/- (তিন লক্ষ) আর্থিক অনুদান প্রদান করছে সরকার। এছাড়া এখন প্র্রবাস থেকে যাওয়া মরদেহ পরিবহন ও দাফন বাবদ আর্থিক সহায়তা হিসেবে ৩৫,০০০/ (পয়ত্রিশ হাজার) টাকা বিমানবন্দরে প্রবাসী পরিবারকে দেওয়া হয়।
ছয়-সাত লক্ষ টাকা দিয়ে ভিসা কিনে আসার তুলনায় এই অংক অপ্রতুল। এই অনুদান দ্বিগুণ করার জন্য নতুন সরকারের কাছে দাবি থাকবে।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে অভিবাসন ঋণ, পুনর্বাসন ঋণ দেয়া হয় কিন্তু সেসব অভিবাসন ঋণ, পুনর্বাসন ঋণ দুটো শতভাগ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সুষম বণ্টন ও নজরদারিতে রাখতে হবে।
সরকার প্রবাসীদের উৎকৃষ্ট সাধনে কাজে যে করছে না তা নয় কিন্তু কাজগুলো প্রবাসীদের অনেকের জানা বা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। যেসব প্রবাসীরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে কর্ম অক্ষম হন সেই সকল কর্মী কল্যাণ তহবিলের অর্থায়নে দেশে ফেরত আনা এবং চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সকল প্রকার ব্যবস্থা করে থাকে সরকার।
যদি অসুস্থ কোন প্রবাসী কর্মী সাহায্যের জন্য কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করেন সেক্ষেত্রে যাচাই পূর্বক সর্বোচ্চ ১,০০,০০০/ (এক লক্ষ) টাকা আর্থিক সাহায্য প্রদান করে সরকার কিন্তু কতজন প্রবাসী সরকারের এই অনুদান বা সেবা পেয়েছে আর কত জন প্রবাসী এই অনুধান বা সেবার খবর জানে তা কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ।
অস্বচ্ছল প্রবাসী কর্মীর সন্তানদের শিক্ষিত জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের অর্থায়নে ২০১২ সাল হতে “শিক্ষা বৃত্তি ও শিক্ষা সহায়ক প্রকল্প” গ্রহণ করেছে সরকার।
বিদেশগামী কর্মীদের যাবতীয় সেবা একই স্থান হতে প্রদানের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ সালে ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেনে ২০ তলা বিশিষ্ট “প্রবাসী কল্যাণ ভবন” উদ্বোধন করেন। এ ভবনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ সংস্থা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বহির্গমন শাখা, বাংলাদেশ ওভারসীজ এমপ্লয়মেন্ট এন্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল) এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক অবস্থিত।
বর্তমানে প্রবাসী কল্যাণ ভবন হতে প্রবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারকে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেবা প্রদান সহ প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের যে কোন সমস্যা সমাধানে প্রবাসবন্ধু কল সেন্টার রয়েছে। সরকারের এসব বহুমুখী সেবার কথা অনেক প্রবাসীরা জানে না। এসব সেবার কথা প্রবাসীদের জানাতে হবে।
প্রবাসীদের জন্য দেশে পুলিশ বাহিনীর জেলা পর্যায়ে প্রথমবারে মতো “প্রবাসী সহায়তা ডেস্ক” চালু করেছে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ, যা এরই মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে। এই জেলার প্রবাসীরাও বেশ উপকৃত হচ্ছে। প্রবাসে বসে দেশের সমস্যা নিরসন করা যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতা চট্টগ্রাম মেট্রােপলিটন পুলিশও “প্রবাসী সহায়তা ডেস্ক” করে। এর বাইরে জানামতে দেশের আরও কোন জেলায় পুলিশ বিভাগে এই ধরনের ডেস্ক নেই। প্রথিটি জেলার এই ধরনের প্রবাসী সহায়তা ডেস্ক চালু করা হলে প্রবাসীদের দূভোর্গ লাগব হবে নিঃসন্দেহে।
নতুন কোন উড়োজাহাজ বিমান বহরে যুক্ত হলে প্রথমে বিশেষ এক রুটে অন্তর্ভুক্তি কিংবা যাত্রী আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ বিশেষ রুটের যাত্রীদের প্রতি বিশেষ অভিনিবেশ এর কারণে মধ্যপ্রাচ্যগামী অভিবাসীদের অধস্তন ভাবাতে বাধ্য করে।
ধরে নিলাম মধ্যপ্রাচ্যের বেশীরভাগ অভিবাসী অন্য অঞ্চলের অভিবাসীর তুলনায় স্বল্প শিক্ষিত, অদক্ষ, আধা-দক্ষ, শ্রমিক শ্রেণীর কিন্তু তাতে কি? অজপাড়া গায়ের কোন এক অল্প শিক্ষিত, ও অদক্ষ বা আধা-দক্ষ অভিবাসী শরীরের ঘামের বিনিময়ে রাষ্ট্রের রিজার্ভ ভোল্ট যদি উর্বর থাকে তাহলে রাষ্ট্র যন্ত্রের মাধ্যমে সেই অভিবাসীদের সার্বিক পরিপোষণ দিতে ক্ষতি কী? আশা করি রাষ্ট্রযন্ত্র এ বিষয়ে আরও ভাববে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বিশ্লেষক