প্রবাসীদের চোখের জলে বিদায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

‘যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়। আপনি আমাদের হৃদয়ে আছেন, থাকবেন। আপনার স্মৃতির কখনও ভুলতে পারবো না ।’ এমন অকৃত্রিম ভালবাসা আর চোখের জলে লেবাননপ্রবাসী বাংলাদেশিরা বিদায় জানালো দেশটিতে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকারকে।

সাড়ে ৪ বছর দায়িত্বপালন শেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফিরছেন বাংলাদেশের চৌকষ এই কূটনীতিক। তিনি ২০১৫ সালের ১২ আগষ্ট বৈরুত দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগদান করেন। তিনি লেবাননে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত । একই সঙ্গে তিনি সাইপ্রাসেরও রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলেন।

রবিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) রাজধানী বৈরুতের আলকোলা রেস্ট প্যালেস অডিটোরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে লেবাননপ্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটি আনুষ্ঠানিক বিদায় জানায় রাষ্ট্রদূতকে। অনুষ্ঠানে সর্বস্তরের কমিউনিটি ব্যক্তিত্বসহ বিপুল সংখ্যাক সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি উপস্থিত ছিলেন।

Travelion – Mobile

লেবাননে কর্মরত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বিশেষজ্ঞ সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্ব করেন বিদায় সংবর্ধনায় রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার প্রধান অতিথি ছিলেন।

 লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের  বিদায় সংবর্ধনায় বক্তারা
লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বিদায় সংবর্ধনায় বক্তারা

মশিউর রহমান টিটু ও রুবেল আহমেদের যৌথ সঞ্চালনায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম সচিব আব্দুল্লাহ আল মামুন, তৃতীয় সচিব আব্দুল্লাহ আল সাফি ও আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই কোরান তেলওয়াত পাঠ করেন হাফেজ মতিউর রহমান ও বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের সম্মানে মানপত্র পাঠ করেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মশিউর রহমান টিটু।

শুরুতেই শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক বাবু সাহা। এরপর বক্তব্য রাখেন লেবাননপ্রবাসী কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব বাবুল মুন্সি, মানিক মোল্লা, সুফিয়া আক্তার বেবি, মনির হোসেন রানা, আলমগীর ইসলাম, শরিফ খান, মনির হোসেন জয়, আবদুল করিম, হাবিবুর রহমান, শামীম আহমেদ, ইন্জিনিয়ার ইমাম হোসেন মিলন ও রীমা আক্তার।

বক্তারা বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের কূটনৈতিক দক্ষতা, গঠনমূলক কর্মতৎপরতা, চারিত্রিক গুণাবলি এবং লেবাননে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নের ভূঁয়সী প্রশংসা করে তাঁকে একজন প্রবাসীবান্ধব রাষ্ট্রদূত হিসেবে খেতাব প্রদান করেন।

বিদায় সংবর্ধনায় সর্বস্তরের কমিউনিটি ব্যক্তিত্বসহ বিপুল সংখ্যাক সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি উপস্থিত ছিলেন
বিদায় সংবর্ধনায় সর্বস্তরের কমিউনিটি ব্যক্তিত্বসহ বিপুল সংখ্যাক সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি উপস্থিত ছিলেন

এছাড়াও লেবাননের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূতকে সম্মাননা ক্রেষ্ট ও ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়।
লেবাননের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূতকে সম্মাননা ক্রেষ্ট ও ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়
লেবাননের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূতকে সম্মাননা ক্রেষ্ট ও ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়

কমিউনিটির নেতারা বলেন, ‘লেবাননে এক লক্ষ ষাট হাজার বাংলাদেশির ছায়া ছিলেন রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকারের । তিনি সর্বদা অসহায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবিভাবকের মত সুখে-দুঃখে পাশে ছিলেন। লেবানিজদের কাছে বাংলাদেশের বার্বমূর্তি উজ্জল করতে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।’

তারা আরও বলেন, মোতালেব সরকার দায়িত্ব পালনকালে সততা, নীতি ও আর্দশে ছিলেন অটল এবং অন্যায়রে বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন । অসাধু দালালদের কঠোর হাতে দমন করা ছাড়া তাদের কাছে কোনদিন আপোষ করেন নাই। তিনি আসার আগে যেখানে দুই হাজার মার্কিন ডলার লাগতো একটিমরদেহ দেশে পাঠাতে করতে সেখানে বিনা খরচে এবং দ্রুত দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি ।

বিদায়ী বক্তব্যে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘মানবতার সেবা করা সবার ভাগ্যে জুটে না। আল্লাহ অশেষ মেহেরবানী আমি এ সুযোগটা পেয়েছিলাম। নানা সীমাবদ্ধতা ও বাধ্যবাধকতার মধ্যে থেকেও সর্বাত্নক চেষ্টা করেছি প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা দিতে, সমস্যা সমাধানে। প্রতিদিন কমপক্ষে একজনকে সাহায্যে করার টার্গেট করেছিলাম যাতে মাসে ৩০ জন আর বছরে ৩৬৫ জনকে সেবা দিতে পারি। জানিনা কতটুকু করতে পেরেছি, আদৌ সফল হতে পেরেছি কিনা।’

প্রবাসে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুন্ন রাখার পাশাপাশি কমিউনিটির মধ্যে ঐক্যমত ধরে রাখতে সকলের প্রতি আহবান জানান বিদায়ী রাষ্ট্রদূত। বলেন, আপনারা অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত থেকে দেশের সম্মানটুকু অক্ষুন রাখবেন। আমি আপনাদের জন্য দোয়া করি মহান আল্লাহতালা কাছে যেন সর্বদা ভালো রাখেন। আপনারাও আমার জন্য ও আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। দীর্ঘ সাড়ে ৪ বছরের দায়িত্বে কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকরে আমাকে ক্ষমা করবেন।’

সাড়ে ৪ বছর দায়িত্ব পালনকালে রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের কল্যাণে নানা যুগান্তকারী উদ্যােগ গ্রহণ করেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অবৈধ হয়ে যাওয়া প্রবাসীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কর্মসূচি, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা কর্মসূচি, অসুস্থ প্রবাসীদের চিকিৎসা ও বৈধকরন প্রক্রিয়া, নিহত প্রবাসীদের মরদেহ দেশে দ্রুত প্রেরণ, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) প্রদান।

এসব কর্মসূচির মধ্যে সবচেয়ে সাড়া জাগানো ছিল লেবাননে অবৈধভাবে দীর্ঘদিন বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার সুযোগ। রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর কঠোর পরিশ্রমে এই বিশেষ সুযোগ অর্জিত হয়।

তার আন্তরিক প্রচেষ্টাই যাত্রা শুরু করে লেবানন-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল। লেবানন-বাংলাদেশের সম্পর্ককে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং দু’দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন, তথ্য বিনিময়, বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশ জ্ঞাতকরণ এবং সর্বোপরি উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই প্লাটফরমটি গঠন করা হয়েছে।

তিনি প্রথম রাষ্ট্রদূত যিনি বাংলাদেশি অধ্যুষিত সাবরা বাজার পরিদর্শন করে প্রবাসীদের খোঁজ খবর নিয়েছিলেন। এছাড়া সাম্প্রতিক ডলার সংকটে প্রবাসীদের দূর্ভোগ নিরসনে লিবান পোস্ট, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ লেবাননের নানা সরকারী দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, দেন দরবার করেন।

এছাড়া রাষ্ট্রদূতের নেওয়া বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা কর্মসূচিও অসহায় প্রবাসীদের জন্য বড় আর্শীবাদ হয়ে দাড়ায়। লেবাননে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিজয়ের চিকিৎসা ইউনিটের সহায়তায় এ পর্যন্ত ১৩টি ক্যাম্পে প্রায় ৫ হাজার লেবাননপ্রবাসী বাংলাদেশি এই কর্মসূচির আওতায় চিকিৎসা সেবা পেয়েছেন।

আগের খবর
লেবাননে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিজে কাঁদলেন,প্রবাসীদের কাঁদালেন

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!