প্রবাসজীবনে হারানোর হিসেব!

প্রবাসীর নীরব কান্না বিলাসবহুল পাঁচ তারকায় ঝিকিমিকি আলোকরশ্মি হয়ে প্রতি রাতেই ডান্স ফ্লোরে ঝড়ে পড়ে।

১২ই নভেম্বর নূতনত্বেভরা অন্যরকম অনুভূতির একটি দিন। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বরের ১২ তারিখ। বাদামী বর্ণের এক বাঙালি যুবক। ভাগ্যের অকৃতিম ইচ্ছায় শুভ্র স্বচ্ছ ধ্রুব তুষার আবৃত ভূখণ্ডে আগমন! সবই অচেনা অজানা। এক ভিন্নধর্মী অনুভূতি। স্বপ্নভরা আঁখি আর বুকভরা প্রত্যাশা। ভাবনায় কল্পনায় শুধুই ‘মাসুদ রানার’ এগিয়ে চলার দৃঢ় দৃপ্ত শপথ ।

কাজী আনোয়ার হোসেনের সিরিয়াল উপন্যাস মাসুদ রানা। আমার খুবই প্রিয় সিরিজ ছিল। মাসুদ রানা সিরিজের সবগুলো পর্বই তখন রপ্ত ছিল। নিজেকে মাসুদ রানার বায়বিক চরিত্র ভেবে সকল প্রতিকূলতায় প্রস্তুত রাখা।

ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি। সেই বাঙালি টকবকে যুবক আমার আগমন! জীবনের প্রথম ভিনদেশে আসা। কি করবো, কি করা উচিত ভাবছি আমি! হেলসিংকির আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্টের ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েছিলাম সেইদিনই আমি। জীবনের প্রথম ভিনদেশি এয়ারপোর্ট চাক্ষুস দেখা। আমার দেশের ঢাকা এয়ারপোর্টের জন্য মৃদু কষ্টবোধ হয়।

Travelion – Mobile

এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যাত্রা শুরু অচিন দেশে! হঠাৎই সাদা সাদা শুভ্র রাশি রাশি স্বচ্ছ তুষারপাত। স্বাগত জানাচ্ছে আমায়! নাকি তিরস্কারের ফুলঝুরির ধবল সাদা পাপড়ি ছড়াচ্ছে। নানা জল্পনা-কল্পনা মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারছে। শুভ্র স্বচ্ছ তুষারকণা সবই ট্যাক্সির গ্লাসে আছড়ে পরে লেপ্টে যাচ্ছে। আর উইপার যুগল ডান-বাম করে চলার পথ দৃশ্যমানে পরিষ্কারের আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।

ট্যাক্সি এয়ারপোর্ট থেকে ১০০ কিলোমিটার ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে চলেছে গন্তব্য পানে! চোখ জুড়িয়ে জীবনের প্রথম শুভ্র স্বচ্ছ তুষার (স্নো) কণার অবলোকন। এটাই যে আমার জীবনের প্রথম তুষার বিলাস। সেটা লজ্জাহীনভাবে বলতেই পারি! চারিধার স্বচ্ছ সাদা বরফের চাদরে ঢাকা। ট্যাক্সির গ্লাস ভেদকরে আমার দৃষ্টি ধবল শুভ্রতায় বিমোহিত। চক্ষুযুগল দূরদৃষ্টি সাদা তুষার ভেদ করে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে? হয়তো জীবনের নুতন ঠিকানা। নুতন এক অচেনা জীবনের অধ্যায়!

অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম! চারিদিকে শুধুই শেতাঙ্গ মানুষের আনাগোনা। নিজ বর্ণের এক জনও এখন পর্যন্ত দৃষ্টিপটে আসেনি! ইংরেজি ভাষায় কুশলাদি বিনিময় করলাম। আমার পরিচয় দেবার চেষ্টা ও সাথে সহযোগিতা কামনাও যে ছিল আমার! ফ্রেস হয়ে ঘাটের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। প্রায় ২৪ ঘন্টার আকাশ যাত্রায় বড্ড ক্লান্ত। রুমের বৃহৎ কাঁচের জানালার দিকে চেয়ে আছি। গ্লাস ভেদ করে আমার চক্ষু যুগল বহুদূরে কোথাও স্থির হয়ে আছে। ভাবনায় শুধুই কি করছি?

গতকাল পড়ন্ত বিকেলে মা বাবার স্বপ্নের চাহনি আমি দেখেছি। আমার জন্যে ভালো থাকার আর্শিবাদ ছিল তাদের মমতায় ভালোবাসায়। আমি শুধু মা-বাবার পদ ধূলি মাথায় নিয়েছিলাম মাত্র। আর দু’আ করো বলে বিড়বিড় করেছিলাম। মা-বাবার আর্শিবাদে আর উপর আল্লাহর ইচ্ছায় ভিনদেশে এক এক করে অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম।

কি পেয়েছি দীর্ঘ প্রবাস জীবনে? জানিনা। কি হারিয়েছি? সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।

জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ আমার মা। শুরুতেই পাঁচ বছরের মাথায় মা আমায় ফাঁকি দিয়ে ওই দূর আকাশে চলে গেছেন । মায়ের ঐ অনাকাঙ্খিত চলে যাওয়া আজও আমায় কাঁদায়। জীবনদশায় মায়ের ভালোবাসার শেষ স্পর্শ ১৯৯৬ সালের ১১ই নভেম্বর। বাবাও ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন ২০১৭ সালের আগস্টে।

আমার ভালোবাসা-আস্থা-ভরসার জায়গাগুলো আমি হারিয়ে ফেলেছি। জীবন থেকে ভিনদেশে যৌবনের শ্রেষ্ঠ বছর গুলো কাটিয়ে দিলাম। যা পেয়েছি তার অনেক গুন বেশি হারিয়েছি। যা হারিয়েছি তা যে আমার পরম সম্পদ ছিল। সেটা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই।

প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় প্রবাস জীবনে এটাই বুঝি পরম প্রাপ্তি আমার? অংকের হিসেবে অর্থপ্রাচুর্য্য বিলাসিতায় প্রাপ্তি হয়তো স্থুল হয়েছে। কিন্তু আমার প্রবাস জীবনে হারানো সম্পদের হিসেব গাণিতিকভাবে কষে বের করা একেবারেই দুঃসাধ্য!

বলতে দ্বিধা নেই দুর্ভাগারাই শুধু প্রবাসী হয়। প্রবাসীরা সবস্থানেই পরবাসী হয়ে যায়। আর প্রবাসীর নীরব কান্না বিলাসবহুল পাঁচ তারকায় ঝিকিমিকি আলোকরশ্মি হয়ে প্রতি রাতেই ডান্স ফ্লোরে ঝড়ে পড়ে।

পলাশ কামালী: প্রবাসী সংগঠক, লেখক-ফিনল্যাণ্ড

[প্রিয় পাঠক, আকাশযাত্রা প্রবাস বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকসহ কমিউনিটি ও সংগঠনের নানান খবর, ভ্রমণ, আনন্দ-বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। লেখা ছবিসহ মেইল করুন [email protected]এই ঠিকনায়]

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!