পাপুলের সংসদ সদস্য পদ আর নেই!

আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত

ঘুষ দেওয়ার মতো ফৌজদারি অপরাধে চার বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কুয়েতের কারাগারে বন্দি লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের সংসদ সদস্য পদ আছে কি না বা তাঁর আসন শূন্য হয়ে গেছে কি না, এ সিদ্ধান্ত জানা যাবে খুব দ্রুতই। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী পাপুলের আসন শূন্য হয়ে গেছে, চলে গেছে তার সংসদ সদস্য পদ। এখন অপেক্ষা স্পিকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার। তিনিই জাতীয় সংসদ ও ইসিকে অবহিত করবেন। এ নিয়ে দৈনিক কালের কন্ঠের বিশেষ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হল।

ঘুষ দেওয়ার দায়ে কুয়েতের আদালত জাতীয় সংসদের লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে চার বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫৩ কোটি ১৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে আনা মানব ও অর্থপাচারের অভিযোগে শাস্তি এখনো ঘোষণা করা হয়নি। গত বছর ৬ জুন কুয়েতের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) পাপুলকে সেদেশে গ্রেপ্তার করে। তখন থেকে এমপি পাপুল কুয়েতের কারাগারে বন্দি। এই সাজা হওয়ার ফলে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) এবং ৬৭(১)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পাপুলের সদস্য পদ থাকতে পারে না। তাঁর আসন শূন্য হয়ে গেছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আইনি বাধ্যবাধকতার কারণেই জাতীয় সংসদের অভিভাবক হিসেবে স্পিকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে আসন শূন্যের ঘোষণা দিতে হবে।

সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ২ নম্বর উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার বা সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি—(ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।’

আর সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হওয়া প্রসঙ্গে বলা আছে। এই অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ (১)-এ বলা হয়েছে, ‘কোন সংসদ-সদস্যের আসন শূন্য হইবে, যদি—(ঘ) তিনি এই সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে (২) দফার অধীন অযোগ্য হইয়া যান।’

Travelion – Mobile

সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এখন কুয়েতের আদালতের রায়ের কপি যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংসদে পৌঁছেছে। স্পিকার পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। ওই সিদ্ধান্তের কথা তিনি সংসদকে অবহিত করবেন। আর আসনটি শূন্য হলেও বিষয়টি লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনকে জানাবেন। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৭২ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, ‘কোনো সংসদ সদস্য ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হলে কিংবা কোনো আদালত কর্তৃক কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে বা কোনো নির্বাহী আদেশক্রমে আটক হলে গ্রেপ্তারকারী বা দণ্ডদানকারী বা আটককারী কর্তৃপক্ষ বা জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে স্পিকারকে জানাবে।’

এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপুলের বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। দ্রুতই সকলকে সংসদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কুয়েতের আদালতের রায়ের বিষয়ে জাতীয় সংসদ অবহিত হয়েছে। রায়ের আরবি অংশ বঙ্গানুবাদ করে পর্যালোচনা করা হবে। আর মূল রায়টি শেষ দিকে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, সেটিও পর্যালোচনা করা হবে। সব কিছু দেখার পর দেশের সংবিধান, কার্যপ্রণালী বিধি ও আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুলের কুয়েতের আদালতে ফৌজদারি অপরাধে চার বছরের সাজার বিষয়টি এখন সকলেরই জানা। পাপুল সে দেশের কারাগারে বন্দি আছেন, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে এটাও জানা গেছে যে এরই মধ্যে ওই সাজার রায় রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ায় জাতীয় সংসদের স্পিকারের হাতে পৌঁছেছে।’

তিনি বলেন, ‘কোনো সংসদ সদস্য যদি ফৌজদারি অপরাধে দুই বছর বা তার বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তাহলে সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনি আর সংসদ সদস্য পদে থাকতে পারেন না। আর ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের বেশি সাজা হলে সংবিধানের ৬৭(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার আসন শূন্য হয়ে যাবে। সংবিধানের এই বিধানের আলোকে এটা বলাই যায়, শহিদ ইসলাম পাপুলের সংসদ সদস্য পদ চলে গেছে। তাঁর সংসদীয় আসন শূন্য হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী আসন শূন্য হলেও কিছু আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। কারণ সংবিধানে সব বলা থাকে না। আইন অনুযায়ী জাতীয় সংসদের অভিভাবক হিসেবে স্পিকারকে ওই আসন শূন্য ঘোষণা করে একটি রুলিং দিতে হবে। লিখিতভাবে সংসদকে জানাতে হবে। এই লিখিত কপি নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে। কারণ এই চিঠি ছাড়া নির্বাচন কমিশন ওই আসনে উপনির্বাচন করতে পারবে না।’

আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, এমপি পাপুলকে কুয়েতের আদালতের দেওয়া রায় হাতে পেয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার। সুতরাং এখন বলাই যায় যে স্পিকার রুলিং দিক আর নাই দিক, লিখিতভাবে আসন শূন্য ঘোষণা করা হোক বা না হোক আইনগতভাবে পাপুল আর সংসদ সদস্য নন, তাঁর আসন শূন্য হয়ে গেছে। তবে সংবিধান অনুযায়ী সব কিছু আপনাআপনি হয়ে যায় না। এ জন্য কিছু আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এই আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী এখন জাতীয় সংসদের স্পিকারকে ওই আসন শূন্য ঘোষণা করতে হবে।’

সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কুয়েতের আদালতে চার বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে সে দেশের কারাগারে বন্দি এমপি পাপুল। এ বিষয় অবহিত হয়েছে জাতীয় সংসদের স্পিকার।’ তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) এবং ৬৭(১)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পাপুলের সংসদ সদস্য পদ থাকার কথা নয়। এখন স্পিকারকে তাঁর আসন শূন্য ঘোষণা করতে হবে। স্পিকার যতক্ষণ আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা না দিচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত পাপুলের আসন শূন্য বলা যাবে না।’

এদিকে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে জাতীয় সংসদের নির্বাচনী হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে পাপুলের সংসদীয় আসন কেন শূন্য ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে জারি করা রুলের ওপর আজ সোমবার বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

প্রতিবেদন : এম বদি-উজ-জামান ও নিখিল ভদ্র, দৈনিক কালের কন্ঠ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!