দূর পরবাসের সংবাদযোদ্ধাদের গল্প কয়জনে জানে!

কামরুল হাসান জনি। সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক। ১০ বছরে প্রবাস জীবনে চাকরির পাশাপাশি শখের বশে সাংবাদিকতায় জড়িয়ে রয়েছেন। বর্তমানে দেশের প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিকে কর্মরত। সে সঙ্গে বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ইউএই’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক । দুটি উপন্যাস ও একটি ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে তার। আকাশযাত্রায় দুইপর্বে তিনি তুলে ধরেছেন প্রবাসে সাংবাদিকতার হালচাল।

সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দূরের মানুষগুলোকে খুব কাছাকাছি দেখছি, তাদের সম্পর্কে জানার সুযোগ হচ্ছে, এমনকি তাদের মনের ভাবও সহজে আঁচ করা যাচ্ছে। কিছুদিন আগে নাগরিক টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক দীপ আজাদ ভাই তার ফেসবুক ওয়ালে সাংবাদিক সংগঠনের নির্বাচন নিয়ে কিছু বিষয় তুলে ধরেন। বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্ববহ মনে হলো। যেখানে কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ ছিল এমন- ‌”নির্বাচন আসলে নানা ছুতায় কিছু সাংবাদিক নেতা দূরে থাকেন। নিজে প্রার্থী হলে ঐক্য, অন্যের বেলায় নাই। আদর্শ শুধু মুখে। ষড়যন্ত্র করতে থাকা। সক্রিয় সাংবাদিকতা না করে অযোগ্য প্রার্থীকে সমর্থন করা। জিততে পারবে না এমন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে বলা। প্রকৃত ও জনপ্রিয় সাংবাদিক নেতাদের মতামত না জানা এবং ঘরের ভেতর ঘর তৈরি করা।”

বিষয়গুলো দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও সাংবাদিক সংগঠনগুলোতে প্রায়ই নজরে পড়ে। বিদেশ না বলে প্রবাস বলাটা ভাল হতে পারে। কারণ দেশীয় গণমাধ্যমে কাজ করা সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীদের ‘প্রবাসী সাংবাদিক’ বলেই পরিচয় দেওয়া-নেওয়া চলে সর্বত্র!

মূল লেখায় যাবার আগে আরো একটি বিষয় যোগ করি। চট্টগ্রামের প্রাচীন পত্রিকা দৈনিক আজাদী। পত্রিকাটির প্রধান প্রতিবেদক হাসান আকবর ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করছিলাম। একপর্যায়ে তিনি বললেন- তাদের পত্রিকায় প্রবাস থেকে কোনো সাংবাদিক নিয়োগ দেয়া হয় না। প্রবাসী সাংবাদিক নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়াটিও রাখা হয়নি পত্রিকার সিস্টেমে। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন কিছু অভিজ্ঞতার কথা। কিছু অসঙ্গতির কথা। যেখানে তিনি কিছু অভিযোগও যোগ করেছিলেন। সেসব অভিযোগ বা অপরাধের দায় নিতে চায় না মিডিয়া বা অফিস কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি যৌক্তিক! কেন দিবেন তবে প্রবাসে সাংবাদিক নিয়োগ? -যদি এমন হয় অথবা ঝুঁকি থাকে অপরাধের! এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলার আছে, কথা বলতে চাই।

বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ইউএই'র অভিষেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সহ সভাপতি আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি কলিম সরওয়ার এবং দুবাই কনস্যুলেটের দূতালয় প্রধান প্রবাস লামারাংসহ ক্লাব নেতৃবৃন্দ । ১৮ জানুয়ারি, ২০১৯
বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ইউএই’র অভিষেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সহ সভাপতি আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি কলিম সরওয়ার এবং দুবাই কনস্যুলেটের দূতালয় প্রধান প্রবাস লামারাংসহ ক্লাব নেতৃবৃন্দ । ১৮ জানুয়ারি, ২০১৯

যাই হোক, লিখব-লিখছি করে সময়েরও বেশি সময় অতিবাহিত হচ্ছে ব্যস্ততায়। কী-বোর্ডের সামনে বসলেও লেখার মত সেরকম মানসিক অবস্থা স্থির হচ্ছে না দীর্ঘদিন। তবে রাতের কোনো অংশে যখন বাসায় ফেরা হয় তখন কর্মব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে ক্লান্ত দুটি চোখ ঠিকই ঢুঁ মারে সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় পাতায়। মনের তাগাদা থাকলেও শরীর যেন সামনে বাড়ে না কিছুতেই। প্রবাসীর হাত, প্রবাসের হাত! এই হাত সারাদিনই অন্যের সুখ-সমৃদ্ধির গল্প লিখেই ক্লান্ত এখন। যেকারণে কী-বোর্ডের সামনে এলে আঙ্গুলগুলো তেজহীন ভাব ধরে বসে। মূলত এই সবই প্রবাসের গল্প। সময় পেরিয়ে গেলে প্রবাসীকে নিজের কাছে নিজেই মূল্য খুঁজতে হয়। কারণ, শতকরা নব্বই শতাংশ পরবাসজীবী একদিন মূল্যহীনের কাতারে দাঁড়ান, হোক ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়!

Travelion – Mobile

কতসব ব্যস্ততার আয়োজন এখানে। তবুও শখের পেশার নেশা যেন ছাড়ে না কিছুতেই। অনেক সময় নির্ঘুম রাত কাটে দুটো লাইন টুকে রাখার চেষ্টায়। রাত গভীর হলেও কখনো কখনো ওই কয়েকটি লাইনকে ধরার নেশা পেয়ে বসে। সেসময় লাইনগুলোর যত্ন নিতে হয়। যত্নে যত্নে বাঁধা লাইনগুলো মাঝে মাঝে ছাপার হরফে কাগজে স্থান পায়। বলা চলে- এতটুকুতেই তৃপ্ত পরবাসের শতভাগ সংবাদকর্মী। সম্মানী বা ভাতার যেন তাড়া নেই তাদের। আজ তাদের নিয়েই গল্প করি, প্রবাসের সংবাদকর্মীদের গল্প।

বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ইউএই'র পতাকাতলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসী সাংবাদিকরা
বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ইউএই’র পতাকাতলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসী সাংবাদিকরা

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম তেল সমৃদ্ধ দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর সরকারিভাবে দেশটিতে ধীরে ধীরে প্রবাসীরা অবস্থান নিতে শুরু করেন। কর্মের সন্ধানে ছুটে আসা বাংলাদেশিরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন পেশায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে সক্ষম হন। তখন যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যমে ছিল চিঠি। চিঠির ভাজে ভাজে শৈল্পিকতা ছিল, মায়া ছিল, ছিল আত্মিক টান। আগ্রহ আর আশা জাগানো কথামালা প্রাণের সঞ্চার ঘটাতো। পাওয়া যেত সাহিত্যের ছোঁয়া। খুব বেশি দূর পড়ালেখা না জানা লোকটিও দু’ কলম চিঠির ভাষায় লেখার চেষ্টা নিশ্চয়ই করতেন! সেই হিসেবে তখন লেখালেখির বেশ চর্চা হতো এটি অনায়াসে স্বীকার করা যায়। শুধু চিঠি লেখা নয় কেউ কেউ সাহিত্য চর্চা করতেন। লিখতেন কবিতা বা গল্প। লেখালেখির মত বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে একটি পাঠক শ্রেণিও তৈরি হয়েছিল তখন। যা ক্রমান্বয়ে বিস্তার লাভ করে।

আশির দশকের কথা, বাংলাদেশ থেকে বাংলা ভাষায় ছাপানো পত্রিকা আসতো সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বাংলা পত্রিকা পড়ার সুবাদে বাংলা ভাষীদের পত্র-পত্রিকায় লেখার চর্চাও শুরু হয় একপর্যায়ে। গুটি কয়েকজন লেখক লিখতেন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকায়। সেসময় আমিরাতে পাকিস্তানি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘মালেক নিউজ এজেন্সি’র মাধ্যমে বিভাগীয় শহরগুলোতে পাওয়া যেত ওসব বাংলা পত্রিকা। সংবাদ বা সাংবাদিকতার বিবেচনা না থাকলেও প্রবাসীদের সুখ-দুঃখ তুলে ধরা মানষগুলোর কদর ছিল বেশ।

বিশ্বজয়ী বাংলাদেশি কন্যা নাজমুন নাহারের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংবাদযোদ্ধারা
বিশ্বজয়ী বাংলাদেশি কন্যা নাজমুন নাহারের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংবাদযোদ্ধারা

একটা সময় পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের দুই দিন পর আসা শুরু হয়। বাংলাদেশি মালিকানাধীন আবু নাছেরের ‘ইত্তেফাক নিউজ এজেন্সি’ প্রবাসীদের বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত পত্রিকা পড়ার সুযোগ আরো সহজ করে দেয়। এরও কিছু সময় পর আমিরাতে বেশকিছু বাংলা পত্রিকা অনিয়মিত প্রকাশনা শুরু হয়। ফলে আরো কিছু লেখক ও সংবাদ প্রেরক তৈরি হন। বাংলা পত্রিকার প্রতি বাড়ে প্রবাসীদের আগ্রহ। মাধ্যমটি কাজে লাগিয়ে হয়েছেন অনেকে সাংবাদিক। সৃষ্টি হয়েছে সাংবাদিকদের সংগঠন।

এরপর হালের পরিবর্তন। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে অনলাইন ও ই-পেপার প্রবাসীদের এখন শতভাগ বাংলা পত্রিকার স্বাদ মেটাতে সক্ষম। এখন দিনের পত্রিকা যেমন দিনে পড়ার সুযোগ হয়েছে, পাওয়া যাচ্ছে মূহুর্তের খবর মূহুর্তেই। প্রিন্ট পত্রিকাগুলো প্রকাশ করছে পরবাসীদের ঘিরে বিশেষ পাতা, টেলিভিশনে পরবাসের সংবাদ ও অনলাইন পোর্টাল গুরুত্ব সহকারে প্রচার করছে প্রবাসীদের খবর। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রবাসে পাঠক, দর্শক, বেড়েছে খবর পৌঁছানো কর্মীর সংখ্যা।

বর্তমানে গণমাধ্যমের পাঠক ও দর্শকদের একটি বড় অংশই জুড়ে রয়েছেন প্রবাসীরা। যে কারণে প্রিন্ট মিডিয়া, অনলাইন আর টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের প্রতিনিধি নিচ্ছে। প্রতিনিধিরাও নিজগুণে প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধিতে শ্রম দিচ্ছেন। আবার ফেসবুক ও ইউটিউবের কল্যাণে কেউ কেউ হয়ে যাচ্ছেন খোদ মিডিয়ার মালিক পক্ষ। বলা যায়- প্রবাসে সাংবাদিকতার এখন যৌবলকাল। কথা হচ্ছে- দূর পরবাসের এই যৌবন যোদ্ধাদের গল্প কয়জনে জানে!

……………দ্বিতীয় পর্বে শেষ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!