দক্ষিণ কোরিয়ায় অমর একুশে উদযাপন

যথাযোগ্য ভাবগাম্ভীর্য ও মর্যাদায় চির প্রেরণার অমর একুশ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদয়াপন করা হয় দক্ষিণ কোরিয়ায়। দিবসটি পালনের জন্য সিউলে বাংলাদেশ দূতাবাস তিন পর্বের অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে।

২১ ফেব্রুয়ারির রাত ১২টা ১ মিনিটে প্রথম প্রহরে আনসান সিটিতে অবস্থিত নির্মিত শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, এক মিনিট নীরবতা পালন ও আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গান গেয়ে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়।

দক্ষিণ কোরিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম শহীদ মিনারে ও দূতাবাস পরিবার প্রথমে পুস্পস্তবক অর্পণ করে মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগকারী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন সিউল দূতাবাসের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারি।

Travelion – Mobile

এ সময় সবাই সমস্বরে অমর একুশের কালজয়ী গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…’। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর রাষ্ট্রদূতসহ সকলে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।

এরপর একে একে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যবৃন্দ এবং কোরিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশিরা শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহরে দক্ষিণ কোরিয়ার আনসান শহরে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষাশহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন সিউলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম ।দক্ষিণ কোরিয়ায় অমর একুশে উদযাপন 1
দ্বিতীয় পর্বে ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে দূতাবাস প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও অর্ধনমিতকরণ করেন রাষ্ট্রদূত। এসময়ে দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কোরিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানের পরবর্তী অংশে ছিল পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে পাঠ, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত বাণীসমূহ পাঠ, ভাষা শহীদদের আত্মার মাগফেরাত এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ মোনাজাত ইত্যাদি। এ উপলক্ষ সাংস্কতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়

উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে দিবসটির তাৎপর্যের উপর আলোকপাত করা হয়। ‘অমর একুশে’ বইমেলায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বঙ্গবন্ধু প্যাভিলিয়নের উপর নির্মিত ভিডিও চিত্রটি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে উক্ত পর্বের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়।

বিকেলে বাংলাদেশ দূতাবাস ও কোরিয়ান ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কোর যৌথ আয়োজনে তৃতীয় পর্বের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং কূটনৈতিকবৃন্দ, দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কোরিয়ান ন্যাশনাল কমিশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্বে ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের উপর নির্মিত একটি তথ্যচিত্র প্রর্দশন করা হয় এবং মহান একুশে ফেব্রুয়ারির মূল সঙ্গীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’পরিবেশন করা হয়। এরপর দিবসটি উপলক্ষ্যে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও ইউনেস্কো-এর মহাপরিচালকের বাণী পাঠ করা হয়।

কোরিয়ান ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেসকোর সেমিনার হলে তৃতীয় পর্বের অনুষ্ঠানে  দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উধ্বতন কর্মকর্তাসহ  বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং কূটনৈতিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন
কোরিয়ান ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেসকোর সেমিনার হলে তৃতীয় পর্বের অনুষ্ঠানে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উধ্বতন কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং কূটনৈতিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন

রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম তার স্বাগত বক্তব্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। তিনি বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের মাতৃভাষার উপর ভিত্তি করে শিক্ষা প্রদানের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরেন এবং এ বছরের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘Language without borders’-এর আলোকে বিবাদ নিরসণে আন্তঃসীমানা ভাষার উপযোগিতার বিষয়ে আলোকপাত করেন।

কোরিয়ান ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেসকোর মহাসচিব কোয়াংহো কিম ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার ২১ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানান এবং বহুভাষাবাদ ও বহুসংস্কৃতিবাদের উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন।

মাতৃভাষা রক্ষার্থে বাংলাদেশের আত্মত্যাগ ও প্রচেষ্টার ইতিহাস তুলে ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া প্রশান্ত বিষয়ক ব্যুরো-এর মহাপরিচালক কিম জুয়াং হান বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সম্প্রীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। স্মারক বক্তব্যের পর যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড, কানাডা ও সিয়েরা লিওনের রাষ্ট্রদূতগণ বহুভাষাবাদের উন্নয়নে তাদের দেশ কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমের উপর বিস্তারিত বক্তব্য প্রদান করেন।

নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ফিলিপ টার্নার বলেন, তার দেশ কয়েক দশকে অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি সমাজে পরিণত হয়েছে। সে কারণে ২০০ এর অধিক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির দেশ নিউজিল্যান্ড তার আদিবাসীদের ভাষা রক্ষায় বদ্ধপরিকর।

বহুভাষাবাদ ও বহুসংস্কৃতিবাদের উন্নয়নের উপর গুরুত্ব প্রদান করে কানাডার রাষ্ট্রদূত মাইকেল ডানাগার জানান, তার দেশে ইংরেজি ও ফরাসী ভাষার পাশাপাশি ১৪০ এর অধিক প্রবাসী ভাষা ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আদি ভাষা রয়েছে। ক্রমশ হারিয়ে যাওয়া আদি ভাষা রক্ষার্থে তার সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। এ সময় তিনি ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির উদ্যোগ গ্রহণকারী কানাডার নাগরিক সালাম ও রফিক-এর কথাও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।

সিয়েরা লিওনের রাষ্ট্রদূত কাথোস জিবাও মাত্তাই তার দেশের ১৬টি বিভিন্ন ভাষার মধ্যে বিরাজমান সম্প্রীতি ও শ্রদ্ধার উপর আলোকপাত করেন।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে কোরিয়ান শিল্পীদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য ও ভারতের কত্থক নৃত্যশিল্পীদের পরিবেশনা সকলকে মোহবিষ্ট করে। সেই সাথে দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ কর্তৃক পরিবেশিত গান সকলে উপভোগ করেন। পরিশেষে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দকে ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশি খাবার পরিবেশন এবং কোরিয়ান ও বাংলা ভাষা সম্বলিত উপহার সামগ্রী প্রদান করা হয়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!