টানা ১১ দিন না ঘুমিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিল যে কিশোর!

আজ ১৩ মার্চ, বিশ্ব ঘুম দিবস। ঘুম নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ২০০৮ সাল থেকে দিবস পালিত হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার কারণে বহু সমস্যার শিকার হন মানুষ। অনেকে আবার শরীরে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন । সেই সকল বিষয়কে আলোয় আনার জন্যই এই দিবসের অবতারণা। বিশ্ব ঘুম দিবসে জেনে নিতে পারি, টানা ১১ দিন না ঘুমিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার সেই অবিশ্বাস্য গল্প, ২০১৮ সালের বিবিসির প্রতিবেদন থেকে।

আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগো শহরের পড়ুয়া ছিল ব়্যান্ডি গার্ডনার। ১৯৬৪ সালের ৮ জানুয়ারি একটানা ১১ দিন না ঘুমিয়ে থেকে হইচই ফেলে দিয়েছিল ১৭ বছরের এই কিশোর। নাম লিখিয়ে ফেলেছিল বিশ্ব রেকর্ডের খাতায়। কিন্তু এই গোটা ঘটনাটির কীভাবে সূত্রপাত হয়েছিল, তা জানলে অবাক হতে হয়।

শোনা যায়, সে বছর তাদের স্কুলে যে বিজ্ঞান মেলা আয়োজিত হয়েছিল, তাতে একটি পরীক্ষা চালানোর বিষয় হিসেবে তারা বেছে নেয় মানুষের ঘুম। র‍্যান্ডি, তার বন্ধু ব্রুস ম্যাকালিস্টার এবং আরও কয়েক জন মিলে ঠিক করে, ঘুম নিয়ে কোনও অভিনব এক থিওরি তৈরি করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেবে তারা। কোনও মানুষকে দীর্ঘ সময় ঘুমোতে না দিলে তাঁর মধ্যে ঠিক কী কী পরিবর্তন আসতে পারে, সেটাই ছিল তাদের পরীক্ষার বিষয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ।

পরবর্তীকালে ব়্যান্ডি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমরা তখন তারুণ্যের দোরগোড়ায়। রক্ত ফুটছে আমাদের। সবসময় নতুন কিছু করতে চাই, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আমরা। তাই বিজ্ঞান মেলাতে আমাদের নতুন কিছু দেখাতেই হতো। আমরা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম, মানুষ যদি বহু ক্ষণ না ঘুমোয়, তাহলে তার মধ্যে কোনও অলৌকিক প্রভাব পড়ে কিনা। তার আচরণে ও কাজকর্মেই বা কীরকম প্রভাব ফেলে এই অবস্থা।”

দুই বন্ধু ব্রুস ম্যাকালিস্টার এবং জো মার্সিয়ানো  র‍্যান্ডি গার্ডনারকে সঙ্গ দিচ্ছেন
দুই বন্ধু ব্রুস ম্যাকালিস্টার এবং জো মার্সিয়ানো র‍্যান্ডি গার্ডনারকে সঙ্গ দিচ্ছেন

এই পরীক্ষা করার জন্য ব়্যান্ডি এবং তার বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিল, তারা একটানা জেগে থাকবে সকলে। তারা এ-ও ঘোষণা করে দিল, একটানা না ঘুমিয়ে থাকার বিশ্বরেকর্ড ভাঙবে তারা। তখনও তারা নিশ্চিত ছিল না এমনটা সম্ভব কিনা। কারণ তখন হনলুলুর এক ব্যক্তির ২৬০ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে থাকার রেকর্ড ছিল।

Travelion – Mobile

ব্রুস বলেছিলেন, “আমরা একটা কয়েন দিয়ে টস করে ঠিক করছিলাম, একটানা জেগে থাকার এই রেকর্ডটি কে করবে। আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম যে টস করার পরে ব়্যান্ডির ঘাড়ে এই দায়িত্বটা পড়েছিল। কারণ আমি হয়তো ওর চেয়ে অনেক আগেই হাল ছেড়ে দিতাম। তখন আমরা বুঝিনি, পরীক্ষা সফল করতে হলে, ব়্যান্ডিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমাদেরও ওর সঙ্গে জেগে থাকতে হবে। ওর ওপর নানা ধরনের পরীক্ষা চালাতে হবে। আমরা তাই করছিলাম। কিন্তু তিন রাত ধরে নির্ঘুম থাকার পরে একদিন দেওয়ালের ওপরেই পড়ে গেলাম ঘুমে। তখন আমরা বুঝতে পারলাম, অন্য কাউকে এই কাজের জন্য নিয়ে আসতে হবে। আমাদের আর এক বন্ধু জো মার্সিয়ানোকে অনুরোধ করলাম জেগে থেকে ব়্যান্ডিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। জো রাজি হল।”

এইভাবে পাঁচ-ছ’দিন কাটার পরে স্থানীয় এক পত্রিকায় খবর হিসেবে প্রকাশিত হয় ব়্যান্ডিদের এই অভিনব পরীক্ষার ব্যাপারে। লেখা হয়, ব়্যান্ডি গার্ডনার নামের এক যুবক না ঘুমিয়ে থাকাপ বিশ্বরেকর্ডটি ভাঙতে চলেছে। খবরটি চোখে পড়ে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ গবেষক উইলিয়াম ডিমেন্টের। তিনি ঠিক করেন, এই বিষয়টি খুঁটিয়ে দেখবেন তিনি। একটি সাক্ষাৎকারে উইলিয়াম বলেছিলেন, “সান দিয়েগোর একটি পত্রিকায় এই ছেলেটাকে নিয়ে একটা খবর বেরিয়েছিল। সে নাকি না ঘুমিয়ে একটানা জেগে থাকার একটা নতুন রেকর্ড করতে চায়। আমি সাথে সাথে ছেলেটার সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, ও কীভাবে ব্যাপারটা ঘটাচ্ছে।”

বর্তমানে উইলিয়াম ডিমেন্ট স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক। বিশ্বে ঘুম নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁকে অন্যতম এক পথিকৃৎ বলে মনে করা হয়।

র‍্যান্ডি গার্ডনারকে সহায়তা করছে দুই বন্ধু ব্রুস ম্যাকালিস্টার (বাম) এবং  জো মার্সিয়ানো  (ডান) । পাশে দিন গণনায়  র‍্যান্ডি ।
র‍্যান্ডি গার্ডনারকে সহায়তা করছে দুই বন্ধু ব্রুস ম্যাকালিস্টার (বাম) এবং জো মার্সিয়ানো (ডান) । পাশে দিন গণনায় র‍্যান্ডি ।

উইলিয়াম ডিমেন্ট ব়্যান্ডিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তখনই। এতে যেন একটু স্বস্তি পেয়েছিলেন ব়্যান্ডির মা-বাবা। তাঁরা খুবই ভয়ে ছিলেন ছেলের এই কাজকর্মে। না ঘুমিয়ে তার শরীরের কোনও ক্ষতি হয়ে যাবে কিনা, তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তাঁরা। এর আগে বিড়ালের ওপর এ ধরনের একটি গবেষণা করা হয়েছিল। কিছু বিড়ালকে ১৫ দিন পর্যন্ত জাগিয়ে রাখা হয়েছিল পরীক্ষার জন্য। কিন্তু এর পরে বিড়ালগুলি মারা যায়। ফলে ব়্যান্ডির মা-বাবার ভয় অমূলক ছিল না।

কিন্তু ব়্যান্ডির বন্ধু ব্রুস ম্যাকালিস্টার জানান, সেই বিড়ালগুলিকে জাগিয়ে রাখার জন্য নানা রকম রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়েছিল। তার ফলেই বিড়লগুলির ক্ষতি হয়। ব়্যান্ডি পরীক্ষা চলার সময়ে মাঝেমধ্যে হয়তো কোক খেত। আর বাকি সাধারণ খাওয়াদাওয়া। অতিরিক্ত কোনও ওষুধ খায়নি সে। বেশ কয়েক দিন পর্যন্ত বেশ তরতাজাই ছিল ব়্যান্ডি। অধ্যাপক ডিমেন্টের সঙ্গেও সুন্দর কথাবার্তা হয়।

ব্রুস আরও বলেন, “তখন আমরা নানা রকম পরীক্ষা চালাচ্ছিলাম। যেমন স্বাদ, গন্ধ, শ্রবণশক্তি এসব ভাল করে মাপছিলাম। কয়েক দিন পরে আমরা দেখতে পেলাম, ধীরে ধীরে তার সজ্ঞান থাকার ক্ষমতা, এমনকি তার ইন্দ্রিয় অনুভূতির ওপর না ঘুমোনোর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কোনও গন্ধ ওর হঠাৎই খারাপ লাগছিল। অথচ বাস্কেটবল দিব্যি খেলছিল ও।”

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!