চীনের উহানে অবরুদ্ধ বাংলাদেশিরা, ফেরার আকুতি
মরণঘাতি নভেল করোনা ভাইরাস চীনের যেই শহর থেকে ছড়িয়েছে সেই শহরের নাম উহান। এটি সেন্ট্রাল চীনের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রখ্যাত প্রদেশ, হুবেইয়ের রাজধানি। বর্তমানে এই শহরের নাগরিক সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ। পড়াশোনাসহ অন্যান্য কাজের সুবাদে এই শহরে বসবাস অন্তত পাঁচশতাধিক বাংলাদেশির। পুরো হুবেই প্রদেশের হিসেবে যা ১ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার্থী, যাদের অনেকেই চীনা নববর্ষের ছুটি কাটাতে চলে এসেছেন বাংলাদেশে। কেউ কেউ এসেছেন করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার বেশ আগেভাগেই কেউবা আবার উহান নগরী পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঠিক আগমুহুর্তে।
তবে দূর্ভাগ্য তাদের যারা চীনা নববর্ষের ছুটিতে বাংলাদেশে আসেননি কিংবা ইচ্ছে থাকলেও আটকা পড়েছেন, যাতায়াত বিচ্ছিন্ন থাকা উহান নগরীতে। প্রসঙ্গত করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় গেল ২৩ জানুয়ারি এক আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে উহান নগরীকে লক ডাউন বা যাতায়াত বিচ্ছিন্ন করে দেয় সরকার। এরপর থেকে সেখানে আটকা পড়েন অনেক বাংলাদেশি, অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে তাদের জীবনযাপন। চীন সরকার জানায়, ভাইরসটির ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বাস, মেট্টো, রেলসহ বন্ধ থাকবে বিমান চলাচলও।
প্রথমদিক থেকে ধীরে ধীরে আতঙ্ক দানা বাঁধতে শুরু করলেও উহানকে বাকী দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার পর তা কার্যত হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি ভুতুড়ে নগরী। চীনা নববর্ষের ছুটিতে এমনিতেই এক সপ্তাহ আগে থেকে দোকানপাট বন্ধ হওয়া শুরু হয়, উপরন্তু ভাইরাস আতঙ্কে ব্যবসা গুটিয়ে এখানকার অনেক দোকানিই নিরাপদ আশ্রয়ে। তাই এখন খাবার এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহের বিষয়টি হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি চরম অনিশ্চয়তার ব্যাপার। কেবলমাত্র সরকারিভাবে খোলা রাখা গুটিকয়েক সুপারশপ বা নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রির নির্দিষ্ট কিছু দোকানই এখন ভরসা।
একদিকে দোকানপাট, বাজার বন্ধ থাকা অন্যদিকে বাইরে বেরিয়ে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক। সবমিলিয়ে খুব উদ্বেগজনক আর ভীতিকর অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন সেখানকার বাংলাদেশী বাসিন্দারা। চীনের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় হুয়াচং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে পিএইচডি করছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক মোল্লা আমিনুল ইসলাম। স্ত্রী এবং এক নবজাতক নিয়ে উহানে আটকে পড়ে নিজেদের অসহায় অবস্থার কথা তুলে ধরলেন তিনি। জানালেন,“উহান শহরের মূল কেন্দ্র থেকে একটু দূরের একটি এলাকায় আমি বসবাস করছি। এখানে এমনিতেই হাতে গোনা কিছু দোকানপাট আছে তার উপর এখনকার নববর্ষ আর ভাইরাসের সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে সব দোকানপাট। অনেক কষ্টে আগামী দুই তিনদিনের খাবার সংগ্রহ করলেও এরপর আসলে কি অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয় তা অনিশ্চিত।”
দূর্ভোগের কথা জানাতে গিয়ে আরও বলেন, “প্রতি মাসে স্ত্রী ও নবজাতককে হাসপাতালে নেয়ার দরকার পড়লেও এবার ভাইরাস আতঙ্কে সেখানে যাওয়ার চিন্তা আপাতত বাদ দিয়েছি। অপেক্ষা করছি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদের নিয়ে হাসপাতালে যাব” ।
এ ব্যাপারে কথা হয়, চীনের সেন্ট্রাল চায়না নরমাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক আবদুল্লাহ আল হাফিজ ও ফারজানা ইয়াসমিন দম্পতির সাথে। গত দুই বছর ধরে তারা পড়াশোনার সুবাদে দুই কন্যা নিয়ে বসবাস করছেন উহানে। বাংলাদেশিদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত কেউ আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ না পেলেও বলেন “ আমাদের মধ্য থেকে এখানে কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত না হলেও বাচ্চাদের নিয়ে ভীতি আর উদ্বেগে গৃহবন্দি জীবন কাটছে। এখানে আমরা যারা বর্তমানে অবস্থান করছি তাদের মধ্যে সাহায্য-সহযোগিতা আর তথ্য আদান প্রদানে সবাই মিলে একটি উইচ্যাট গ্রুপ খুলেছি। এই গ্রুপটি হুবেই প্রদেশে আটকে থাকা বাংলাদেশিদের নিয়ে খোলা হয়েছে যেখানে সদস্য সংখ্যা তিন শতাধিক”।
তারা আরও বলেন, “গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত বাহন বন্ধ থাকায় চীন সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের যাতায়াতে বিশেষ সেবায় বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকেও আমাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে। তবে এমন অবস্থায় দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আমরা বাংলাদেশি দূতাবাসের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি”।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক পিএইচডি গবেষক শামীমা সুলতানা দুই মেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন উহানে। জানান, ভাইরাস আতঙ্কে গৃহবন্দি অবস্থায় ছোট দুই মেয়ে নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে তাঁর। এরমধ্যে অনেক দূর্ভোগ পোহানোর পর আগামী এক সপ্তাহের খাবার আর নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতে পারলেও আছেন চরম মানসিক চাপে।
তিনি বলেন “এই মুহুর্তে যদি দেশে ফিরে যাওয়ার কোন সুযোগ থাকতো আমরা আমরা আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতাম না। কিন্তু বাস, প্লেন, ট্রেন সবই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফেরার কোন পথ নেই।”
চীনের উহানে গেল ৫ বছর ধরে বসবাস করছেন উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, চট্টগ্রামের অর্পণ বড়ুয়া। গেল প্রায় ৫ বছর ধরে চীনে বসবাস করলেও প্রথমবারের মত এমন পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়েছেন বলে জানান তিনি। “নববর্ষের ছুটিতে এমনিতেই আমাদের এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যায় তাই আগে থেকেই সৌভাগ্যবশত কিছু খাওয়ার সংগ্রহে রেখেছিলাম। তবে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মিটরিতে নিজ কক্ষে গৃহবন্দি জীবন কাটছে”।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন “ আমিসহ আরো অর্ধশতাধিক বাংলাদেশি এখানকার ইন্টারন্যাশনাল ডর্মে অবস্থান করছি। এখানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাইরাসের কোন লক্ষণ দেখা দিলেই সাথে সাথে যাতে ব্যবস্থা নেয়া যায় সেজন্য ডর্মগুলোর প্রবেশপথে বসানো হয়েছে থার্মাল ডিটেক্টর। দেয়া হয়েছে ফেস মাস্ক ও থার্মোমিটার, স্থাপন করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ টিম”।
উহান জিওসায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবির চৌধুরি জানান, একদিকে চীনা নববর্ষে এমনিতে জনমানবশূণ্য উহান নগরী উপরন্তু শাট ডাওনের পর থেকে শহরটি কার্যত ভতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। আফসোসের সুরে বললেন, “নববর্ষে ছুটিতে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য অনেক পরিকল্পনা থাকলেও এখন শাট ডাউনের কারণে সব পরিকল্পনা বাতিল করে অবরুদ্ধ জীবনযাপন করতে হচ্ছে”।
ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আতঙ্কে উহান নগরীতে আটকা পড়া বেশ কিছু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন। তারা দেশে ফিরে আসার আকুতি জানিয়ে চেয়েছেন দূতাবাসের সহায়তা। তাদের অনেকেই নিজেদের অসহয়াত্ব আর আশঙ্কার কথা দূতাবাসকে অবহিত করেছেন, চেয়েছেন জরুরী সহায়তা।
এদিকে চীনের বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে করোনাভাইরাসের এই বিস্তারকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথেই দেখছে তারা। ভাইরাসে কোন বাংলাদেশি আক্রান্ত হলে বা বিশেষ প্রয়োজনে সহায়তা দিতে জরুরি হটলাইন চালু করার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। গেল শনিবার (২৫ জানুয়ারি) পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সামাজিকমাধ্যমে একটি বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, বাংলাদেশিদের সহযোগিতা দিতে বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে এরই মধ্যে হটলাইন চালু করা হয়েছে (হটলাইন নম্বর (৮৬)-১৭৮০১১১৬০০৫)।
তবে বিবিসি বাংলার একটি সংবাদে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অফ মিশন মাসুদুর রহমান জানান, চীনা সরকার এখনও যেহেতু কাউকে সরিয়ে নেয়ার কোন নির্দেশনা দেয়নি, তাই আমরা সেটা করতে পারছি না। এখন চীনা স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতর বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যে পরামর্শ দিচ্ছে সেগুলো মেনে চলতে বলছি।”
লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, সেন্টাল চায়না বিশ্ববিদ্যালয়, উহান, চীন