খাসাবের টুকরো গল্প : ২২০ টাকায় ৪০ কেজি মাছ, ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড!

২২০ টাকায় ৪০ কেজি মাছ!
আরব সাগরের মাছ গুলো দেখতে অতটা সুন্দর না৷ যেমনটা বাংলাদেশের মিঠা পানির মাছ ৷ কোনটা তো দেখতে এতটাই ভয়ঙ্কর যে, আমাদের দেশের মাছগুলোর সাইজ এবং আকারে সঙ্গে তুলনা করলে ওকে মাছ বলে পরিচয় দিতে আপনার ভয় হবে ৷ কিছু মাছ দেখা যায় যার দাঁতগুলো নেকড়ের মতো৷

আবার কিছু মাছের চোখ গুলো মায়া হরিণের মত ৷ এই যেমন মধ্যপ্রাচ্যে বিখ্যাত হামুর মাছ হা করলে জিভ বের হয়ে আসে, মনে হয় মানুষের জিভ ৷ দেখতে কিছুটা ডোরাকাটা লালচে বর্ণের। অনেক সময় হামুর মাছ শরীরের চামড়া অজগর সাপের মতো মনে হয়৷

কিন্তু আমার হাতে যে মাছটি দেখছেন, এটি হরমুজ প্রণালী থেকে ধরা হয়েছে ৷ মাছটির নাম ইফি ৷ ওমানের প্রত্যেকটি জায়গাতেই এই মাছটি কমবেশি ধরা পড়ে ৷ আরব সাগরের দেখতে সুন্দরতম মাছ হলেও খেতে তেমন একটা সু-স্বাদু না ৷ কেউ এই মাছগুলো দিক তাকিয়ে থাকলে এমনি জেলেরা দিয়ে দেয়, ‘চাহিবার আগেই দিতে বাধ্য থাকিবে’ নীতিতে ৷

ওমানের খাসাবের ফিসারিঘাটে হরমুজ প্রণালী থেকে ধরা ১০ কেজির ইফি মাছ হাতে লেখক
ওমানের খাসাবের ফিসারিঘাটে হরমুজ প্রণালী থেকে ধরা ১০ কেজির ইফি মাছ হাতে লেখক

এখানে বাংলাদেশিরা হামুর ছাড়া সাগরের অন্য মাছ খুব একটা পছন্দ করে না ৷ একদম না পারলে মাছ খায়৷ আবার এই মাছগুলো কাটতেও আলাদা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ৷ অনেক সময় দেখা গেছে না কাটতে পেরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে ৷

Travelion – Mobile

আমার জেলে বন্ধু আব্দুল্লাহ খুমজারি আজ (শনিবার) এই একটি ১০ কেজি ওজনের মাছ আমাকে দিতে চেয়েছিল আমি নেইনি ৷

আমি ওকে বললাম, এটার দাম কত?

উনি বললেন, ‘মাফি ফুলুস (মানে কোন টাকা লাগবে না)’।

আমার পাশে দাঁড়ানো ফিশারি ঘাটের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাজে নিয়োজিত একজন প্রবাসী বাংলাদেশি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, ‘ভাই চারটার দামে এক রিয়াল’।

তার মানে দাঁড়ালো ৪ টা মাছের মােট ৪০(১০x৪) কেজির দাম ওমানি এক রিয়াল, যা বাংলাদেশি ২২০ টাকা মাত্র৷

আমার আর বুঝতে বাকি রইল না করোনাভাইরাসেরজন্য তেলের মত মাছের দাম পড়ে গেছে ৷

ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড
“স্যার, আপনার ওয়াইফাই এর পাসওয়ার্ডটা একটু দেন না, বাড়িতে একটু কথা বলব৷ অনেকদিন কথা হয় না, জানি না করোনায় পরিবার ক্যামন আছে৷”

পাসওয়ার্ড দেওয়াটা বড় রকম ঝুঁকি থাকা সত্বেও দোতালার বারান্দা থেকে ওদেরকে বললাম লেখো:

খাসাব সিটি কর্পোরেশনের প্রবাসী পরিচ্ছন্ন কর্মী
খাসাব সিটি কর্পোরেশনের প্রবাসী পরিচ্ছন্ন কর্মী

‘Khasab2020’ K টা বড় হাতের ৷
স্যার একটা একটা করে অক্ষর বলেন:
King মানে রাজা, কিং এ K (K টা বড় হাতের)
লিখেছ? জি স্যার লিখেছি, দুজনে একসঙ্গে পরের টা বলেন ৷
hot মানে গরম, হট এর h (ছোট হাতের অক্ষর)
amma এ a (ছোট হাতের অক্ষর)
school এ s (ছোট হাতের অক্ষর)
আবার, আম্মাজানের এ a (ছোট হাতের অক্ষর)
baba এ b (ছোট হাতের অক্ষর)
এবার এ বছরের সাল লেখ 2020.
হইছে?

“জি স্যার হইছে, লাইন লাগছে ৷”

দাঁত বের করে কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে বলল, “স্যার ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন, আমরা আপনাদের শহর পরিষ্কার রাখব৷”

ওরা সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মী ৷ আমাকে চেনে, আমারও মুখচেনা। এখন এই রোজার সময় ভোর পাঁচটা থেকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত ওদের ডিউটি ৷ এখন বেলা এগারোটা বাজে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি গাড়ি আসবে৷ তারপর ওরা ক্যাম্পে ফিরে যাবে৷

আরব দেশগুলিতে ইন্টারনেটের দাম, আমাদের দেশের মতো অতো সহজলভ্য নয় ৷ এখানে আমাকে এক মাসে 4G ওয়াইফাইয়ের ১২০ জিবি প্যাকেজের জন্য ২৫ ওমানি রিয়াল ব্যয় করতে হয় ৷ যা বাংলাদেশি ৫ হাজার ৫০০ টাকা (প্রতি রিয়াল ২২০ বাংলাদেশি মুদ্রা হিসেবে) ৷

মাসে বাংলাদেশি ১৫ হাজার টাকা বেতন পায় এই প্রবাসী পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। থাকার জায়গা কোম্পানি দেয়। খাবারটা নিজেরই ব্যবস্থা করতে হয় ৷ এখন এই করোনাভাইরাসের মহামারি পরিস্থিতির মধ্যে সন্ধ্যার পর বের হতে পারে না, ক্যাম্পে বসে থাকে ৷

ক্যাম্পে ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা নেই ৷ যেমন আগে সন্ধ্যার পর বিভিন্ন মার্কেটে যেত যেখানে ওয়াইফাই ফ্রি পেতে। অবসরে বসে দেশে কথা বলতো। পরিবারের খোঁজ খবর নিতো। নিজের খোঁজ খবর দিত ৷

কষ্ঠ করে একটা মোবাইল ফোনের মালিক হতে পারলেও ব্যয়বহুল ইন্টারনেট পরিষেবা নেওয়া সঙ্গত কারনেই তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বায়না আমার কাছে।

ওরা খাবারের জন্য ছয় হাজার টাকা রেখে ১০ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। আর বিদেশে এসেছে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা খরচ করে, কেউ লোন করে, কেউ ভিটে বেঁচে!

লেখক: ওমানপ্রবাসী বাংলাদেশি প্রকৌশলী

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!